পাকিস্তানের স্কুল-কলেজে একাত্তর ও বাংলাদেশ: পাঠ্যবইয়ে কী শেখানো হয়

 

ইতিহাস ক্লাশে পাঠদানরত একজন শিক্ষক, ইনসেটে পাঠ্যবইয়ের প্রচ্ছদ


১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পাকিস্তানের পাঠ্যবইয়ে কীভাবে চিত্রিত হয়? কিভাবে ইতিহাস বিকৃত করে গড়ে তোলা হচ্ছে তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গি—জানুন বিশ্লেষণে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুধু বাংলাদেশ নয়, উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও রক্তক্ষয়ী অধ্যায়। এই যুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেয় একটি স্বাধীন দেশ—বাংলাদেশ। কিন্তু পাকিস্তানে এই ইতিহাস কীভাবে উপস্থাপিত হয়? পাকিস্তানের পাঠ্যপুস্তকে কী শেখানো হয় বাংলাদেশের জন্ম এবং মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে?

এই প্রশ্নগুলো কেবল ইতিহাসের অনুসন্ধিৎসুদের নয়, বরং রাজনীতি, কূটনীতি, ও জনগণের পারস্পরিক বোঝাপড়ার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


আরও পড়ুনঃ বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলন: একটি নতুন রাষ্ট্রের সম্ভাবনা ও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক বাস্তবতা

 

পাঠ্যবইয়ে ইতিহাসের ‘পুনর্লিখন’

পাকিস্তানের স্কুল-কলেজের ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান পাঠ্যবইগুলোতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে সরাসরি “Fall of East Pakistan” অর্থাৎ “পূর্ব পাকিস্তানের পতন” নামে উল্লেখ করা হয়। এতে বাঙালিদের দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন তা না তুলে ধরে, এ ঘটনাকে ভারতের ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে চিত্রিত করা হয়।

 

উদাহরণস্বরূপ:

  • ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ইতিহাসের পাঠ্যবইয়ে বাংলাদেশের জন্মকে বলা হয়, “an Indian conspiracy to break Pakistan.”
  • কয়েকটি বইতে বলা হয়, “India trained and armed separatists in East Pakistan and intervened militarily in 1971.”

এখানে “মুক্তিযোদ্ধা”, “গণহত্যা”, “বাঙালি জাতীয়তাবাদ”, কিংবা “জয় বাংলা”—এমন শব্দ একেবারেই অনুপস্থিত।

 

একতরফা ব্যাখ্যা ও তথ্য গোপন

পাকিস্তানের পাঠ্যবইগুলোতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা, নারী নির্যাতন, কিংবা সাংস্কৃতিক নিধনের বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক গবেষকদের মতে, ৩০ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছিল, দুই লক্ষেরও বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হন—এই বিষয়গুলো পাঠ্যবইয়ে একবারের জন্যও উল্লেখ করা হয় না।


আরও পড়ুনঃ বাংলাদেশে পাকিস্তানের আইএসএই-এর স্লিপার সেলের উপস্থিতিঃ একটি বিশ্লেষণ

 

কী শেখানো হয়:

  • শেখানো হয় যে ভারতীয় সেনাবাহিনী হঠাৎ আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানের পূর্ব অংশ দখল করে নেয়।
  • পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে “সাহসী” এবং “দেশপ্রেমিক” হিসেবে তুলে ধরা হয়, যারা ‘বিদ্রোহ দমন’ করছিল।
  • মুক্তিযুদ্ধ নয়, বলা হয় “Civil War instigated by India.”

 

‘ইতিহাসচর্চা’ নয়, রাষ্ট্রীয় ব্যাখ্যা

পাকিস্তানের ইতিহাস শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য বাস্তবে ইতিহাস জানানো নয়, বরং একটি নির্দিষ্ট জাতীয়তাবাদী বয়ান গেঁথে দেওয়া। অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়ে এসেও জানে না বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।

একজন পাকিস্তানি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী হয়তো জানবেই না:

  • কেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জাতির পিতা’ বলা হয়।
  • কেন ৭ মার্চের ভাষণ ঐতিহাসিক।
  • কেন ২৫ মার্চ রাতে “অপারেশন সার্চলাইট” ছিল গণহত্যার সূচনা।


২০২৪ সালের আগস্ট মাসে ইসলামাবাদের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের পতাকা



আরও পড়ুনঃ দারা আদম খেল: পাকিস্তানের অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার হুমকি


তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিভ্রান্তি ও ভ্রান্তি

এই ধরণের শিক্ষাব্যবস্থা তরুণদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি একটি অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর ধারণা তৈরি করে। অনেক পাকিস্তানি নাগরিক মনে করেন, বাংলাদেশ তাদের কাছ থেকে ‘চুরি’ করে নেওয়া হয়েছে, অথবা ভারত জোর করে তা ছিনিয়ে নিয়েছে।

 

এতে দক্ষিণ এশিয়ায় জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও ঐতিহাসিক বোধ গড়ে ওঠে না। বরং ভুল ইতিহাসের ভিত্তিতে তৈরি হয় সন্দেহ, শত্রুতা ও বৈরিতা।

 

বিকৃত ইতিহাসের পরিণতি

পাঠ্যবইয়ে ইতিহাস বিকৃত করার পরিণতি শুধু অ্যাকাডেমিক পর্যায়ে থাকে না। এর প্রভাব পড়ে জাতীয় চিন্তাধারায়, কূটনৈতিক সম্পর্কেও। পাকিস্তান এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি—এর একটি বড় কারণ ইতিহাস বিকৃতির এই প্রবণতা।

এদিকে বাংলাদেশের পাঠ্যবইয়ে ১৯৭১-এর ইতিহাস তুলনামূলকভাবে বিস্তারিত এবং ন্যায্যভাবে উপস্থাপিত হলেও অনেক সময় পাকিস্তানের দিকটি পুরোপুরি বাতিল করে দেওয়া হয়, যা কখনো কখনো পারস্পরিক বোঝাপড়াকে আরও জটিল করে তোলে।


আরও পড়ুনঃ হোয়াইট হাউজে পাকিস্তানি সেনাপ্রধানের লাঞ্চ: এক নজিরবিহীন কূটনৈতিক বার্তা?

 

উপসংহার

পাকিস্তানের স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে যা শেখানো হয়, তা আসলে একটি একপাক্ষিক রাষ্ট্রীয় বিবরণ। এখানে সত্যকে এড়িয়ে যাওয়া হয়, ইতিহাসকে একটি জাতিগত অহংকার রক্ষার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বিকৃত ইতিহাস জাতির ভবিষ্যতের জন্য ভয়ংকর—তা পাকিস্তান হোক বা অন্য যেকোনো দেশ।

 

বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস একটি মানুষের আত্মত্যাগ, সংগ্রাম ও স্বপ্নের কাহিনী। তা শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বে একটি অনন্য স্বাধীনতা আন্দোলনের দৃষ্টান্ত। একে গোপন করে রাখা যায় না। সত্য ইতিহাস জানার এবং জানানোর দায়িত্ব আমাদের সবার।


আরও পড়ুনঃ ইমরান খানের বিস্ফোরক অভিযোগ: প্রতিহিংসার কেন্দ্রে ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির

 

📚 সূত্রসমূহ:

  • বাংলা ট্রিবিউন (জুন ২০২৫)
  • দ্য ডেইলি স্টার (২০১০)
  • Herald, Dawn (Pakistan)
  • পাকিস্তান ন্যাশনাল কারিকুলাম কাউন্সিল রিপোর্ট (NCC)
  • Human Rights Watch, 1971 genocide documentation

Post a Comment

أحدث أقدم