দারা আদম খেল: পাকিস্তানের অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার হুমকি

 


শিরোনামে যে প্রথম বাক্যটি দেখছেন। এটা খেলাধুলার কোনোকিছু না। এটা পাকিস্তানের একটি শহরের নাম। “দারা আদম খেল।”

দারা আদম খেল পাকিস্তানের একটি বিখ্যাত অবৈধ অস্ত্র বাজার, যা শুধু জঙ্গি গোষ্ঠীর অস্ত্রের জোগানই দেয় না, বরং নারী ও ড্রাগ পাচারেরও কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে—বাংলাদেশসহ গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য যা এক গভীর উদ্বেগের কারণ।

 

বিশ্বের নানা প্রান্তে অস্ত্র ব্যবসা একটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হলেও, পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের একটি অঞ্চল—দারা আদম খেল—এ যেন অস্ত্র একটি দৈনন্দিন পণ্যে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের হাটবাজারে যেমন চাল, ডাল ও তেল সহজলভ্য, তেমনি দারা আদম খেলের বাজারে অবৈধভাবে মিলছে ভয়ংকর আগ্নেয়াস্ত্র।

 

অস্ত্রের বাজার: এম-১৬ থেকে একে-৭৪

প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাত্র ৩০ হাজার পাকিস্তানি রুপিতে (বাংলাদেশী ১২৯০০ টাকা) পাওয়া যাচ্ছে মার্কিন সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত এম-১৬ রাইফেলের ক্লোন সংস্করণ। এমনকি ১০ হাজার রুপিতে (৪৩০০ বাংলাদেশি টাকা) মিলছে আধুনিক একে-৭৪, যা একে-৪৭ থেকেও উন্নত। এ অঞ্চলে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে পেন গান, রকেট লাঞ্চার এমনকি বিমান বিধ্বংসী অস্ত্রও।

দারা আদম খেলের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের জীবিকা জড়িত এই অস্ত্র উৎপাদন ও বিক্রির সাথে। বছরে প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার অবৈধ অস্ত্র লেনদেন হয় এখানে। এই অস্ত্রের বড় একটি অংশ ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে, যা শুধু পাকিস্তানের অভ্যন্তরেই নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তার জন্যও মারাত্মক হুমকি।

 

বাংলাদেশে অস্ত্র প্রবাহ ও জঙ্গি সংযোগ

২০২৩ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে সংঘটিত কিছু জঙ্গি ষড়যন্ত্রে ব্যবহৃত ৭.৬২ এমএম বুলেটের উৎস হিসাবে সন্দেহ করা হয় পাকিস্তান-আফগান সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলিকে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী যেমন লস্কর-ই-তৈয়বাজইশ-ই-মুহাম্মদ এ অঞ্চলের অস্ত্র বাজারের সাথে গভীরভাবে যুক্ত।

এ ধরনের অস্ত্র ও জঙ্গিদের সরবরাহ, পরোক্ষভাবে হলেও, দক্ষিণ এশিয়ায় উগ্রবাদী তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। পাকিস্তানের সীমান্ত দুর্বলতা ও আইনের প্রয়োগহীনতা এই প্রক্রিয়াকে আরো সহজ করে তোলে।

 

ড্রাগ পাচার: আফগানিস্তান থেকে পেশোয়ার হয়ে বিশ্ববাজারে

পাকিস্তান শুধু অবৈধ অস্ত্র ব্যবসার কেন্দ্র নয়, বরং আফগানিস্তান থেকে উৎপাদিত হেরোইন ও অন্যান্য মাদক দ্রব্য পাচারের একটি প্রধান রুট হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। ২৬৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ ডুরান্ড সীমান্ত দিয়ে কাবুল থেকে দারা আদম খেল হয়ে মাদক চলে যায় পেশোয়ারে। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং এমনকি দক্ষিণ এশিয়াতেও।

এই ড্রাগস পাচার শুধু জনস্বাস্থ্য বা আইনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি নয়, এটি অনেক জঙ্গি গোষ্ঠীর অর্থের উৎস হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে বলে জানা গেছে।

 

নারী পাচার ও চীনের ভূমিকা

একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে পাকিস্তান থেকে চীনে মুসলিম নারী পাচারের অভিযোগ উঠে এসেছে। ২০১৯ সালে Associated Press (AP)-এর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়, কমপক্ষে ৬২৯ জন পাকিস্তানি নারীকে বিয়ের নামে চীনে পাচারের সময় আটক করা হয়েছিল, যদিও পরবর্তীতে বেশ কয়েকজন চীনা নাগরিক দায়মুক্তি পান।

এ ধরনের মানবপাচার, বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায়ের নারীদের ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক অপরাধচক্র গড়ে ওঠার আশঙ্কা বেড়েছে। চীনে একই কৌশলে বাংলাদেশি নারীদেরও টার্গেট করার অভিযোগ রয়েছে।

 

বাংলাদেশে পাকিস্তানপ্রীতি: ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি?

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পার হলেও, এখনও একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী রয়েছে যারা পাকিস্তানকে রাজনৈতিক বা আদর্শিকভাবে অনুসরণ করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক এমনকি চিন্তা-পদ্ধতিতে যেখানে কোনো মিল নেই, সেখানে কিসের ভিত্তিতে এই ঐক্য?

পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামো আজও একটি নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র ও সামরিক হস্তক্ষেপের চক্রে আবদ্ধ। সেখানে বারবার দেখা যায় মৌলবাদী গোষ্ঠী, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা (ISI) এবং বিদেশী কূটনৈতিক প্রভাব একসাথে কাজ করছে। বাংলাদেশ যদি ঐতিহাসিক ভুলের পুনরাবৃত্তি করে, তাহলে তা হতে পারে একটি বিপজ্জনক ধারা।

 

উপসংহার

পাকিস্তান একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক দেশ হলেও, এর অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা অত্যন্ত জটিল। অস্ত্র ও মাদক পাচার, নারী পাচার, এবং জঙ্গি কার্যকলাপের মতো অপরাধ পাকিস্তানকে শুধু নিজেই নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোকেও অস্থির করে তুলছে।

বাংলাদেশের উচিত হবে এই বাস্তবতাকে বিবেচনায় রেখে জাতীয় নিরাপত্তা, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ও সামাজিক সচেতনতা জোরদার করা। পাশপাশি, ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য একটি স্বাধীন, মানবিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে সচেষ্ট হওয়া।

----------

পাকিস্তান অস্ত্র বাজার, দারা আদম খেল, অবৈধ অস্ত্র পাকিস্তান, জঙ্গি সংযোগ বাংলাদেশ, লস্কর-ই-তৈয়বা, জইশ-ই-মুহাম্মদ, পাকিস্তান নারী পাচার, চীন পাকিস্তান সম্পর্ক, ড্রাগস পাচার, দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা

 

You may also like:

দারা আদম খেল অস্ত্রের মার্কেট

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ

বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা


 

বিশ্বস্ত সোর্স (উল্লেখযোগ্য সংবাদসূত্র ও গবেষণা প্রতিবেদন):

  1. Darra Adam Khel Arms Market

Al Jazeera – Pakistan's Gun Bazaar

  1. পাকিস্তান থেকে চীনে নারী পাচার

Associated Press Report, 2019

  1. পাকিস্তানের মাধ্যমে ড্রাগস পাচার

UNODC Report on Drug Routes through Pakistan

  1. লস্কর-ই-তৈয়বা ও জইশ-ই-মুহাম্মদের ভারত-বাংলাদেশ সংযোগ

Brookings Institute – Pakistan’s Jihad Policy

  1. বাংলাদেশে ৭.৬২ বুলেট ও অস্ত্রের উৎস
বিভিন্ন গোয়েন্দা প্রতিবেদন ও মিডিয়া সংস্থা, যেমন Daily Star, BBC Bengali

Post a Comment

Previous Post Next Post