সেনাপ্রধানের নীরবতা ও ভূমিকা: সাংবিধানিক বিশ্লেষণ

 

জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান

২০২৫ সালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের নীরব অবস্থান কী বার্তা দিচ্ছে? এই বিশ্লেষণে উঠে এসেছে সংবিধান, নির্বাচন ও সামরিক নিরপেক্ষতার দিকগুলো।

 

ভূমিকা

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নির্বাচনের আলোচনা চলাকালে জনগণ ও বিশ্লেষকরা নজর রেখেছেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। এর মধ্যে সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও কৌতূহলোদ্দীপক প্রতিষ্ঠান হলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই এক জটিল রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে পড়েছে দেশ। এ অবস্থায় সেনাবাহিনী রয়েছে একপ্রকার 'প্রাতিষ্ঠানিক নীরবতা'য়। এই অবস্থান প্রশ্ন তুলছে—এটা কি গণতন্ত্র রক্ষায় সচেতন নিরপেক্ষতা, না কি কোনো চাপের ফল?


আরও পড়ুনঃ- সংবিধান ও সেনাবাহিনী: সংকটকালিন রাষ্ট্রপতির কর্তৃত্ব

 

সাংবিধানিক কাঠামো ও বাহিনীর ভূমিকা

বাংলাদেশ সংবিধানের ৬১ ও ৬২ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সশস্ত্র বাহিনী রাষ্ট্রপতির অধীন। সরকার প্রয়োজনে তাদের ব্যবহার করতে পারে—তবে এ ব্যবহারের ধরন সংবিধান, আইন ও গণতান্ত্রিক মানদণ্ডের ভেতরে থাকতে বাধ্য। 



প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সশস্ত্র বাহিনীকে লজিস্টিক সাপোর্ট দেয়া।

 


সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান তাই মূলত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা। তারা প্রশাসনিক কিংবা রাজনৈতিক দলাদলিতে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারে না—এটি সংবিধান পরিপন্থী এবং অতীত অভিজ্ঞতায় জটিলতার জন্ম দিয়েছে।


আরও পড়ুনঃ- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ২০২৫: রয়টার্সের প্রতিবেদনে যা উঠে এসেছে

 

সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের অবস্থান: নীরবতা না দূরদর্শিতা?

২০২৪ সালের ২৩ জুন দায়িত্ব নেওয়ার পর জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এখনো পর্যন্ত রাজনৈতিক ইস্যুতে কোনো সরাসরি বক্তব্য দেননি।
এই “কৌশলগত নীরবতা” অনেকের কাছে পেশাদারিত্বের প্রতীক হলেও, অন্য একাংশ মনে করছে—বর্তমান পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর স্পষ্ট অবস্থান না নেওয়া জনগণের আস্থা ও সংকট-উত্তরণকে বিলম্বিত করতে পারে।

এই প্রশ্নগুলো ক্রমশ উঠে আসছে:

  • সেনাবাহিনী কি সত্যিই নিরপেক্ষ থাকতে পারছে?
  • রাষ্ট্রীয় সংকটে তাদের ভূমিকা কী হবে—কঠোর সংবিধান অনুসরণ, না অতীতের মত 'নেপথ্য সক্রিয়তা'?

 

আরও পড়ুনঃ- জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান: দায়িত্ব, চরিত্র ও ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ


নির্বাচন, অন্তর্বর্তী সরকার ও সামরিক নিরপেক্ষতা

যেহেতু দেশ এখন এক অনাকাংখিত সংকটকাল অতিবাহিত করছে এবং নির্বাচন ও নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, অনেকে সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধান প্রত্যাশা করছেন।
তবে ২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক অভিজ্ঞতা এবং আন্তর্জাতিক নজরদারির কারণে বর্তমান বাহিনী এমন রাজনৈতিক ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপে আগ্রহী নয় বলেই মনে হচ্ছে।


আরও পড়ুনঃ- ২১ মে সেনাপ্রধানের দরবারে আলোচিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ

 

এক্ষেত্রে সেনাপ্রধানের নীরব অবস্থান একদিকে শৃঙ্খলা ও প্রাতিষ্ঠানিকতা রক্ষা করলেও, অন্যদিকে এটি আস্থাহীন জনগণের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে।

 

জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের ইতিহাসে জনআন্দোলনের সময়ে সেনাবাহিনী কখনো কখনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে—১৯৯০ সালের এরশাদ পতন তার উদাহরণ।
তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠানগত দায়িত্বপালনে দৃশ্যত পেশাদার এবং এটি ভবিষ্যতের গণতন্ত্র রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে।

 

উপসংহার

জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে—যেখানে গণতন্ত্র, শৃঙ্খলা ও রাষ্ট্রের স্বার্থকে একসঙ্গে সামলাতে হচ্ছে।
এই নীরবতা যদি সত্যিকার অর্থে দায়িত্বশীলতার পরিচায়ক হয়, তবে তা ভবিষ্যতে বাহিনীর মর্যাদা ও জনআস্থা বৃদ্ধির পথে সহায়ক হবে।
কিন্তু যদি তা নিষ্ক্রিয়তা বা সংকট-পরিহারের চেষ্টা হয়, তবে সেটি আরও বড় সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে।

গণতন্ত্রের যাত্রায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা সবসময় সরল নয়—তবে সর্বদা সংবিধান ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থাকা তাদের প্রধান কর্তব্য।

Post a Comment

أحدث أقدم