জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান: দায়িত্ব, চরিত্র ও ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ

 

প্রতীকী ছবি



বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গৌরবের ইতিহাস ও বর্তমান বিতর্ক

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুধু একটি সামরিক বাহিনী নয়—এটি এক গৌরবময় ঐতিহ্যের ধারক, যার জন্মই হয়েছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েমুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ করাটা ছিল প্রতিটি সৈনিকের জন্য এক ভয়ঙ্কর ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত—যেখানে জীবনও ছিল অনিশ্চিতদেশ মাতৃকার স্বাধীনতা অর্জনে সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা সদস্যরা জীবন বাজি রেখে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। সেক্টর কমান্ডারদের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল মুজিবনগর সরকারের অধীনে প্রথম সংগঠিত মুক্তিবাহিনী, যেখানে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ও সৈনিকদের অবদান ছিলো অতুলনীয়। 


এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুধু একটি সামরিক শক্তি নয়—বরং দেশের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা, গণতান্ত্রিক সম্ভাবনা এবং স্বাধীনতার চেতনার রক্ষক হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। সময়ের পরিক্রমায় বাহিনীর দায়িত্ব পালনের ধরনে পরিবর্তন এলেও জনগণের প্রত্যাশা একই—সেনাবাহিনী যেন সর্বদা পেশাদার, নিরপেক্ষ এবং সাংবিধানিক আদর্শে অনুগত থাকে। 


ইতোপূর্বে যেসব সেনা শাসক এসেছে তার পটভূমি বিবেচনা করলে দেখা যাবে, তা ছিল ক্ষমতার লোভে দেশী-বিদেশী ইন্ধনে মুষ্টিমেয় কিছু উচ্চ পদস্থ সেনা কর্মকর্তার উচ্চাভিলাস চরিতার্থের  ফল। এতে সব সেনা সদস্য যে একমত ছিল তা মনে করার কারণ নেই। সেনাবাহিনী একটি কঠোর আইন দ্বারা পরিচালিত সুশৃংখল বাহিনী। হিসেবের গড়মিল হলে কোর্ট মার্শালে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদন্ড অনিবার্য, যা জিয়াউর রহমান, এমনকি এরশাদের সময়ও দেখা গেছে।


২০২৪ সালের ৫ আগস্ট এই ঐতিহ্যবাহী বাহিনী আবারও ইতিহাসের এক সংবেদনশীল সময়ে দাঁড়ায়। দেশজুড়ে রাজনৈতিক সমঝোতা ও ক্ষমতার রদবদল ঘটে—যা নিয়ে তৈরি হয় বহু প্রশ্ন। এই সময়ে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে আসেন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তার নেতৃত্ব, চরিত্র ও ভুমিকা নিয়ে আজ দেশের রাজনৈতিক ও নাগরিক চেতনায় শুরু হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা।


বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, যার ভূমিকা শুধু সামরিক সীমাবদ্ধতায় নয়—জাতীয় স্থিতিশীলতা ও রাষ্ট্রীয় ভারসাম্য রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ। এই বিশাল বাহিনীর নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তি, সেনাপ্রধান, স্বভাবতই জাতীয় বিতর্কে চলে আসেন যখন রাজনীতিতে অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন দেখা দেয়।


২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশে ঘটে এক অনাকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক রদবদল—যা কেউ কেউ বলেন ‘প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস’, আবার কেউ বলছেন ‘অঘোষিত অন্তর্বর্তী সরকার’। এই সংবেদনশীল মুহূর্তে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে আসেন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ এবং পরবর্তী সময়ের ভূমিকা নিয়ে জনমনে যেমন প্রশংসা, তেমনি রয়েছে দ্বিধা ও প্রশ্নবোধকতা।


 আরো পড়ুনঃ সংবিধান ও সেনাবাহিনী



জেনারেল ওয়াকারুজ্জামানের পরিচয় ও পেশাগত জীবন

জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হন। তিনি সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে একজন দক্ষ পরিকল্পনাবিদ এবং অপারেশনাল কমান্ডার হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি পেশাগত জীবনে সেনা গোয়েন্দা বিভাগ (DGFI), মিলিটারি অপারেশনস, এবং শান্তিরক্ষা মিশনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।

 

নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য:

  • দৃঢ় কিন্তু নিরবধি: আত্মপ্রচারে অনাগ্রহী হলেও সিদ্ধান্তে কঠোর।
  • স্ট্র্যাটেজিক মাইন্ডসেট: বাহিনীর অভ্যন্তরীণ শক্তিকে স্থির রেখে বাইরের প্রভাব মোকাবিলার দক্ষতা।
  • সাংবিধানিক সচেতনতা: তার ঘনিষ্ঠ সূত্র অনুযায়ী, তিনি সব সময় আইনের পরিধির মধ্যে থেকে কাজ করার পক্ষে।

 

৫ আগস্ট ২০২৪: একটি সন্ধিক্ষণ

৫ আগস্ট ২০২৪, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক মোড় ঘোরানো দিন। সরকার পরিবর্তন হয় আকস্মিকভাবে—কোনো নির্বাচন ছাড়াই, একটি স্বল্পমেয়াদি প্রশাসন গঠন হয় রাজনৈতিক সমঝোতার নামে।

এই সময়টিতেই জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান দায়িত্ব নেন সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে। ফলে অনেকেই মনে করেন, নতুন প্রশাসনের জন্মলগ্ন থেকেই সেনাবাহিনীর একটি ‘নীরব প্রত্যক্ষতা’ ছিল।

 

তিনটি দৃষ্টিভঙ্গি উঠে আসে:

  1. আন্তঃসংস্থা সমন্বয়কারী: অনেকে বলেন, তিনি ‘বেসামরিক সমাধান’ বাস্তবায়নে একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করেন, যাতে সংঘাত না হয়।
  2. মধ্যপন্থী নিরপেক্ষতা: আরেক পক্ষের মতে, তিনি বাহিনীর নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছেন, কিন্তু যেহেতু বাহিনী কোনো ধরনের প্রতিরোধ দেখায়নি—তা একরকম ‘নীরব সম্মতি’ হিসেবেই দেখা যায়।
  3. নেতিবাচক সহায়তাকারী: সমালোচকরা বলেন, কোনো সাংবিধানিক ব্যাখ্যা ছাড়াই একটি প্রশাসনের জন্ম—যেখানে বাহিনীর সহানুভূতি বা সম্মতি না থাকলে সেটি সম্ভব হতো না।

 

সেনাপ্রধানের ভূমিকাকে ঘিরে দুইমুখী প্রতিক্রিয়া

প্রশংসা:

  • সংঘর্ষ, সেনা-হস্তক্ষেপ বা রক্তপাতহীন একটি সমঝোতা প্রক্রিয়ার বাস্তবায়নে সেনাবাহিনী নিরপেক্ষ থেকেছে।
  • জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এর নেতৃত্বে বাহিনী কোনো উস্কানিতে সাড়া দেয়নি—এটি প্রশংসনীয়।

সমালোচনা:

  • অরাজনৈতিক বাহিনী হয়েও সেনাবাহিনী যদি একটি অর্নির্বাচিত প্রশাসনের ক্ষমতায় আসার সময় নীরব থাকে, তা কি গণতন্ত্রের পরিপন্থী নয়?
  • “নিরপেক্ষতা” আদতে কি রাজনৈতিকভাবে সুবিধা দেওয়া নয়?

 

তিনি আসলে কেমন?

জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সম্পর্কে যারা কাছ থেকে কাজ করেছেন, তারা বলেন তিনি:

  • কৌশলী এবং দূরদর্শী – দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেন না, পরিস্থিতি দেখে পরিপূর্ণ চিন্তা করে পদক্ষেপ নেন।
  • জনসংযোগে সীমিত – মিডিয়াতে উপস্থিতি কম, যা তাকে নিয়ে জল্পনা বাড়িয়েছে।
  • ‘প্রতিষ্ঠান আগে’ নীতি অনুসারী – নিজের ভাবমূর্তির চেয়ে বাহিনীর ঐতিহ্য ও স্থিতিশীলতা রক্ষা তার কাছে বড়।

এমনকি ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়েও তিনি প্রকাশ্যে তেমন কোনো বক্তব্য দেননি—যা একদিকে দায়িত্বশীলতা, অন্যদিকে স্বচ্ছতার অভাব বলেও ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।


 আরো পড়ুনঃ ২১ মে সেনা দরবারে আলোচিত সেনা প্রধানের বক্তব্য


সেনাবাহিনীর ভেতরের রাজনৈতিক সচেতনতা ও শৃঙ্খলা

যদিও সেনাবাহিনীতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ, তথাপি এর প্রতিটি সদস্য ব্যক্তিগতভাবে রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন। তাদের অনেকেই আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতি বিষয়ে প্রগাঢ় জ্ঞান রাখেন, কারণ এটি তাদের প্রশিক্ষণ ও পেশাগত উন্নয়নের অংশ। মানুষ মাত্রেই ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক মত থাকতে পারে, এবং সেনা সদস্যরাও এর ব্যতিক্রম নন।


তবে একটি বিষয় স্পষ্ট—সেনাবাহিনী একটি সুশৃঙ্খল ও কঠোর আইন দ্বারা পরিচালিত প্রতিষ্ঠান। এখানে ব্যক্তিগত মত বা বিশ্বাসকে প্রাতিষ্ঠানিক আচরণে রূপ দেওয়ার সুযোগ নেই। অতীতে দেখা গেছে, কেউ শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে বা দায়িত্ব বহির্ভূত কিছু করলে তাকে কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।


তাই দু’একজন নিম্নপদস্থ সদস্যের বিচ্ছিন্ন ও বিতর্কিত আচরণ দিয়ে পুরো বাহিনীর ভাবমূর্তি বিচার করা যুক্তিযুক্ত নয়। বরং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে প্রতিটি কর্মকাণ্ডের পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ন হবে, এবং কেউ অন্যায় করে থাকলে তা আইনের আওতায় আসবে—এই প্রত্যাশাই বাহিনীর নৈতিক কাঠামোর অংশ।


 আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ২০২৫


ভবিষ্যতের মূল্যায়ন

বাংলাদেশের ইতিহাস বলছে—সেনাবাহিনীর ভূমিকা কোনো সংকটময় সময়ে বড় হয়ে ওঠে। জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এর নাম এখনই পরিপূর্ণভাবে মূল্যায়ন করা কঠিন হলেও একথা বলা যায়:

  • তিনি যদি শান্তিপূর্ণ ক্ষমতার রূপান্তর নিশ্চিত করে থাকেন, তবে ইতিহাস তাকে স্থিতিশীলতার কারিগর বলবে।
  • আর যদি এক অনির্বাচিত কাঠামোর পৃষ্ঠপোষক হিসেবে প্রতিপন্ন হন, তবে ইতিহাস তাকে কঠোর চোখে দেখবে।


উপসংহার

বাংলাদেশের বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দায়িত্ব পালন করছেন। একদিকে তাঁর নেতৃত্বে বাহিনী দৃশ্যত নিরপেক্ষ থেকেছে, অন্যদিকে এই নিরবতা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তিনি একজন কৌশলী, সংযত ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি দায়বদ্ধ সেনা কর্মকর্তা—কিন্তু ইতিহাস কীভাবে তাকে স্মরণ করবে, তা নির্ধারিত হবে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সৎ সাহস, এবং সেনাবাহিনীর নিজের অবস্থান ধরে রাখার ক্ষমতার ওপর। এই অস্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীতে বিভেদ সৃষ্টির প্রচেষ্টা হয়েছে বলেই ধারণা করা হয়—এবং এখনো এমন চেষ্টা চলছে না, সেটাও নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। তবে সেনাপ্রধান সেই বিভ্রান্তিকে মোকাবিলা করে বাহিনীর শৃঙ্খলা ও সংহতি বজায় রেখেছেন, যা দূরদর্শিতা ও নেতৃত্বের পরিচয় বহন করে।

আরো পড়ুনঃ সেনা আইনে অবসরপ্রাপ্তদের বিচার

 

Post a Comment

Previous Post Next Post