প্রতীকী ছবি |
ভূমিকা
সম্প্রতি বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্য এবং সংবাদ প্রতিবেদনে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা Inter-Services Intelligence (ISI)–এর স্লিপার সেল (Sleeper Cell)–এর উপস্থিতির সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা জোরালো হয়েছে। স্লিপার সেল বলতে বোঝানো হয় এমন গোপন সংগঠন বা সদস্যদের দল যারা বহুদিন ধরে ইনএকটিভ অবস্থায় থাকে, কিন্তু প্রয়োজন পড়লেই সক্রিয় হয়ে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমে লিপ্ত হতে পারে।
বাংলাদেশে এরকম সেল থাকার আশঙ্কা কি শুধুই গুজব, না কি এর পিছনে রয়েছে বাস্তবতাভিত্তিক নিরাপত্তা হুমকি? আসুন বিষয়টি বিশ্লেষণ করি।
স্লিপার সেল কী?
স্লিপার সেল হলো এমন একটি গোয়েন্দা বা জঙ্গি নেটওয়ার্ক যা সাধারণ নাগরিকের মতো আড়ালে থাকে। তারা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত নিস্ক্রিয় থাকে, কিন্তু বিশেষ কোনো পরিকল্পনা অনুযায়ী হঠাৎ সক্রিয় হয়ে পড়ে।
এই ধরনের সেলগুলো সাধারণত:
- লোকাল লোকজনকে নিয়োগ করে (র্যাডিক্যালাইজ করে),
- বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার নির্দেশে কাজ করে,
- মিথ্যা পরিচয়ে বাংলাদেশে বসবাস করে থাকে।
আইএসআই ও দক্ষিণ এশিয়া: ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
আইএসআই-এর কার্যক্রম কেবল পাকিস্তানের সীমায় সীমাবদ্ধ নয়। এটি:
- আফগানিস্তানে তালেবানকে দীর্ঘদিন সহায়তা করেছে
- কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদকে উস্কানি দিয়েছে
- ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে জঙ্গি হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে
বাংলাদেশেও ১৯৭১ সালের পর থেকে সময় সময় আইএসআই-এর সরব বা গোপন তৎপরতার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশে আইএসআই: কিছু গুরুত্বপূর্ণ নজির
-
১৯৯০-এর দশক:
- চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে আইএসআই-এর উপস্থিতির আলামত পাওয়া যায়।
- হুজি (হরকতুল জিহাদ) ও জামা’আতুল মুজাহিদিনের (JMB) সাথে আইএসআই-এর যোগসূত্র নিয়ে তদন্ত হয়।
-
২০১৫ সালে ভারতের "ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (NIA)":
- তারা দাবি করে, ঢাকাস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনের ভেতরে আইএসআই অর্থায়নে নাশকতার পরিকল্পনা হচ্ছিল।
- একজন পাকিস্তানি কূটনীতিককে বাংলাদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়।
-
২০১৬–১৭: হোলি আর্টিজান হামলা পরবর্তী গোয়েন্দা অনুসন্ধান:
- আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগ থাকলেও, কিছু তথ্য উঠে আসে যা পাকিস্তানভিত্তিক রুটিংয়ের ইঙ্গিত দেয়।
আইএসআই-এর বাংলাদেশে কৌশল কী হতে পারে?
-
ধর্মীয় চরমপন্থার উস্কানি:
- ধর্মীয় সংবেদনশীলতা কাজে লাগিয়ে জঙ্গিবাদ ছড়ানো।
-
রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি:
- নির্বাচনী সময়ে সহিংসতা ও গুজব ছড়িয়ে জনমনে বিভ্রান্তি।
-
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে অবনতি ঘটানো:
- ভারতবিরোধী উগ্র গোষ্ঠীকে প্ররোচিত করা।
-
জাল পাসপোর্ট ও হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তর:
- অর্থনৈতিকভাবে নাশকতা ও অবৈধ লেনদেন।
বাংলাদেশের করণীয়
বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই নিচের পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেছে বা করা উচিত:
- গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমন্বয় জোরদার করা – NSI, DGFI, RAB, CID ইত্যাদির মধ্যে তথ্য বিনিময় বাড়ানো।
- জঙ্গি অর্থায়ন চিহ্নিত ও বন্ধ করা – মানি ট্রেইল ও হুন্ডি নিয়ন্ত্রণ।
- মাদ্রাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নজরদারি বাড়ানো – যাতে কেউ চরমপন্থার প্রশিক্ষণ না দিতে পারে।
- বিদেশি দূতাবাস ও হাইকমিশনগুলোর কার্যক্রমে নিয়মিত পর্যালোচনা।
উপসংহার
আইএসআই-এর মতো একটি পেশাদার গোয়েন্দা সংস্থার উপস্থিতি বাংলাদেশে ততটা সরাসরি নাও হতে পারে, কিন্তু স্লিপার সেল বা স্থানীয় এজেন্টদের মাধ্যমে তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আঞ্চলিক ভূরাজনীতি, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক এবং ধর্মীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ একটি 'ভালনারেবল' পয়েন্ট। সুতরাং, শুধু আইনশৃঙ্খলা নয়, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং জনসচেতনতা একযোগে থাকলেই এই জাতীয় নিরাপত্তা হুমকি প্রতিরোধ করা সম্ভব।
Post a Comment