![]() |
ছবি: প্রতীকী |
বাংলাদেশে বেআইনি সরকারের আবির্ভাব, সেনাবাহিনীর সাংবিধানিক করণীয় ও রাষ্ট্রপতির ভূমিকা নিয়ে বিশ্লেষণ। সংবিধান রক্ষা ও সার্বভৌমত্ব বজায় রাখার আইনি দিকও আলোচিত।
—একটি সাংবিধানিক বিশ্লেষণ
১. বেআইনি সরকার সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করলে সেনাবাহিনীর সাংবিধানিক করণীয়
যদি কোনো সরকার অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে এবং দেশের সার্বভৌমত্ব বা সংবিধানের মৌল কাঠামো বিলুপ্তির চেষ্টা করে, তাহলে কী সশস্ত্র বাহিনী কিছু করতে পারে? শুধু সরকারের আদেশ মানা, নাকি সংবিধান রক্ষা করা—এ প্রশ্নই আজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
সংবিধান কী বলে?
৭(১) অনুচ্ছেদ: “All powers in the Republic belong to the people... under, and by the authority of, this Constitution.”
৭(২): “This Constitution is the supreme law of the Republic...”
এই দুই অনুচ্ছেদ স্পষ্ট করে যে, সরকার নয়, সংবিধানই চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ।
সেনাবাহিনীর শপথ:
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে শপথ নেয় সংবিধান রক্ষা ও নিরাপত্তা বিধানে। বেআইনি শাসক সংবিধান লঙ্ঘন করলে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব হয় রাষ্ট্রপতির বৈধ আদেশে সংবিধান রক্ষা করা।
অসাংবিধানিক সরকার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করলে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সক্রিয় হয়ে সংবিধান রক্ষার পদক্ষেপ নিতে পারে—এই চেতনা সংবিধানেই নিহিত।
২. সশস্ত্র বাহিনী কি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে, নাকি রাষ্ট্রপতির অধীনে?
বাংলাদেশে সশস্ত্র বাহিনীর সাংবিধানিক কর্তৃপক্ষ কে? রাষ্ট্রপতি নাকি সরকার? অনেকেই মনে করেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ই সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক, কিন্তু সত্যতা একটু জটিল।
সংবিধানীয় কাঠামো:
৬২ অনুচ্ছেদ: “The President shall be the Supreme Commander of the defence services.”
৪৮(৩): রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিসভার পরামর্শে কাজ করবেন।
৫৫(২): প্রধানমন্ত্রী সরকারের প্রধান এবং সমস্ত প্রশাসনিক দায়িত্ব তাঁর।
বাস্তবতা:
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর অধীনে। রাষ্ট্রপতি শীর্ষপদে থাকলেও তাঁর পদ অনেকটা সাংবিধানিক আলঙ্কারিক যদি না বিশেষ সংকট দেখা দেয়।
কিন্তু ব্যতিক্রম কবে ঘটবে?
যদি সরকার সংবিধানবিরোধী হয় বা সার্বভৌমত্ব ধ্বংসের পথ বেছে নেয়, তখন রাষ্ট্রপতি নিজের সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে সেনাবাহিনীকে আহ্বান করতে পারেন।
সাধারণ পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী সরকার তথা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। তবে সংকটকালে রাষ্ট্রপতিই শেষ আশ্রয়স্থল ও সর্বাধিনায়ক।
৩. সংবিধানবহির্ভূত অন্তর্বর্তী সরকার: আইনত বৈধ নাকি ক্ষমতার খেলা?
বাংলাদেশের সংবিধানে বর্তমানে কোনো অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান নেই। তারপরও কেউ যদি শক্তির বলে এমন সরকার গঠন করে, সেটা কি আইনত বৈধ?
সাংবিধানিক বাস্তবতা:
১৫তম সংশোধনী (২০১১) তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছে।
সংবিধানে এখন শুধুই নির্বাচিত সরকার পরিচালনার বিধান রয়েছে।
তবুও যদি কেউ ক্ষমতা দখল করে?
২০০৭ সালের ১/১১ সরকার কোনো নির্বাচনের মাধ্যমে আসেনি।
তখন রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে শপথ নিয়ে একটি “care-taker” সরকার চালু হয়।
পরবর্তীতে আদালত বলেছিল: এটা সংবিধানবহির্ভূত হলেও পরিস্থিতির চাপে 'নির্বাচন অনুষ্ঠান' পর্যন্ত সীমিত স্বীকৃতি পেতে পারে।
কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী ক্ষমতা কি বৈধ?
না। শক্তির জোরে ক্ষমতা দখল করে সরকার চালানো গণতন্ত্র ও সংবিধান বিরোধী—যার নজির পাকিস্তান ও বাংলাদেশের আদালতই বাতিল করেছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন অবৈধ। যদি কেউ শক্তির বলে সেটি চাপিয়ে দেয়, তাহলে সেটা বৈধ নয়—শুধু বাস্তবতায় টিকে থাকার একটি খোলস মাত্র।
৪. সংবিধান রহিত করার চেষ্টা: রাষ্ট্রদ্রোহ নাকি শুধু ‘রাজনৈতিক কৌশল’?
যদি কোনো গোষ্ঠী বা সরকার সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করার চেষ্টা করে, সেটা কি রাজনৈতিক পদক্ষেপ না কি রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ?
সংবিধান ৭(২):
“This Constitution is the supreme law of the Republic...”
বাংলাদেশ দণ্ডবিধি:
ধারা ১২১: রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা বা সহায়তা করলে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন।
ধারা ১২৪A: Sedition বা রাষ্ট্রের প্রতি ঘৃণা ছড়ানো অপরাধ।
সংবিধান রহিত করা মানে কী?
এটা গণতন্ত্র, আইনের শাসন, ও জনগণের সার্বভৌমত্ব ধ্বংস করা।
যে গোষ্ঠী এটা করে, তারা জনগণের মালিকানার ভিত্তিতে গঠিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার শত্রু।
রাষ্ট্রপতির ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ:
যদি তাঁকে অকার্যকর করা হয় এবং সরকার এককভাবে অধ্যাদেশ জারি করে সংবিধান পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়, সেটা সরাসরি রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র।
সংবিধান রহিত বা স্থগিত করার চেষ্টা একটি গুরুতর রাষ্ট্রদ্রোহ। এটা কেবল রাজনৈতিক ভুল নয়, বরং একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ, যা আইনের কাঠামোতে সর্বোচ্চ শাস্তিযোগ্য।
শেষকথা:
একটি রাষ্ট্র তখনই টিকে থাকে, যখন তার সংবিধান টিকে থাকে। সরকারের অস্তিত্ব সংবিধানের ওপরে নয়, বরং সংবিধানই তার জন্মদাতা। অতএব, বেআইনি সরকারের বেআইনি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর (বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি ও সেনাবাহিনী) ভূমিকা কেবল নৈতিক নয়, সাংবিধানিক দায়িত্বও বটে।
Post a Comment