অবিদ্যা রাজার গল্প

 

প্রতীকী ছবি

একদিন এক রাজা তার সভা পন্ডিতকে প্রশ্ন করলেন, "বলুন তো পন্ডিত মশাই, অবিদ্যা (অজ্ঞতা) কি?"


পন্ডিত কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, "মহারাজ, এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য আমাকে ৫ দিন ছুটি দিতে হবে। ফিরে এসে আমি আপনার প্রশ্নের জবাব দেব!"


রাজা সম্মত হয়ে পন্ডিতের ৫ দিনের ছুটি মঞ্জুর করলেন। পন্ডিত রাজমহল থেকে বের হয়ে রাজ্যের সবচেয়ে দক্ষ জুতার কারিগরের কাছে গিয়ে বললেন, "আমাকে একজোড়া জুতা বানিয়ে দাও।"

 

কারিগর সপ্রশ্ন চোখে বললো, "ঠিক আছে হুজুর, মাপটা দিন।"


পন্ডিত ধমক দিয়ে বললেন, "ওসব মাপ টাপ ছাড়ো, এক হাত লম্বা আর এক বিঘৎ চওড়া জুতা বানাও, আর ওতে কিছু হিরে জহরত মণি মাণিক্য জুড়ে দাও! সোনায় মোড়ানো সুতো দিয়ে সেলাই করো। টাকার চিন্তা করো না, যা দাম হবে তাই পাবে, দরদাম করবো না।"

 

কারিগর সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলো, "ঠিক আছে, কিছু টাকা আগাম দিন, ১ দিন বাদে এসে জুতা নিয়ে যাবেন।"

 

দ্বিতীয় দিন জুতা বুঝে নেবার সময় পুরো টাকা দেবার আগে পন্ডিত কারিগরকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন যে এই জুতার গল্প সে কারও কাছে করবে না।


তারপর পন্ডিত একপাটি জুতা নিজের কাছে রেখে অন্য পাটিটি সবার অলক্ষ্যে একটি মন্দিরের সামনে ফেলে রাখলেন।

 

সন্ধ্যায় পুরোহিত মন্দিরে এসে ওই একপাটি জুতা আবিষ্কার করে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। তিনি চিন্তা করলেন, এতো বড় জুতা কখনও কোনো মানুষের পায়ের হতে পারে না, আর যা হীরা জহরত লাগানো তাতে নিশ্চয়ই রাতে মন্দিরে স্বয়ং ভগবান এসেছিলেন এবং বাইরে ভুল করে এই একপাটি জুতা ফেলে চলে গেছেন।

 

পুরোহিত প্রথমে জুতোর পাটিটা মাথায় ঠেকালেন, তারপর বার বার জুতাটাকে চুমু খেতে লাগলেন। পরদিন যখন মন্দিরে অনেক লোক সমাগম হলো পুরোহিত সবাইকে ভগবানের জুতা পাওয়ার গল্প শুনিয়ে দিলেন। সকলে একবাক্যে স্বীকার করলো, নিশ্চয়ই এই জুতা ভগবানেরই হবে, মানুষের পায়ের মাপ এতো বড় হতেই পারে না। আর মন্দিরের বাইরে যখন পাওয়া গেছে তখন নিশ্চয়ই শয়তানেরও নয়! সবাই মিলে জুতাটি বারবার মাথায় ঠেকাতে আর চুমু খেতে লাগলো।

 

নিমেষেই এই জুতার কথা রাজ্যময় ছড়িয়ে গেলো। শেষ পর্যন্ত জুতার গল্প রাজার কানেও গেলো। তিনি জুতাটি রাজ দরবারে পেশ করতে আদেশ দিলেন।


সব দেখেশুনে রাজাও স্বীকার করলেন, "এ জুতা ভগবানের না হয়ে পারে না!" তিনি জুতাটি বারবার মাথায় ঠেকিয়ে আর চুমু খেয়ে বললেন, "এই জুতা কোনো মন্দির বা পবিত্র স্থানে যত্ন এবং নিরাপত্তা সহকারে সংরক্ষণ করা হোক।"

 

প্রতিদিন হাজার হাজার লোক জুতা দেখতে ভিড় জমাতে লাগলো। অনেকে রোগমুক্তি সহ বিভিন্ন কিছু পাবার আশায় মানত করা শুরু করলো। সুযোগ বুঝে একদল লোক জুতার পাশে একটা দান বাক্স লাগিয়ে দি্লো। জুতাকে কেন্দ্র করে জমে উঠল টাকার পাহাড়!

 

৫ দিন পর পন্ডিতের ছুটি শেষ হলো। তিনি রাজসভায় প্রবেশ করে রাজাকে কুর্নিশ করলেন এবং চুপচাপ বসে রইলেন।

রাজা প্রশ্ন করলেন, "কি হলো পন্ডিত, আপনি এমন বিরসবদন কেন?"

পন্ডিত মাথা নিচু করে বললেন, "মহারাজ, আমার বাড়ি থেকে একপাটি জুতা চুরি গেছে, তাই আমার মন খারাপ।"

"একপাটি জুতা ?"- রাজা আকাশ থেকে পড়লেন।

"হ্যাঁ, আমার প্রপিতামহের একটি জুতা চুরি গেছে, পালানোর সময় চোর একপাটি ফেলে গেছে!"

"ওই জুতাটি কি আপনার কাছে আছে?" রাজার তড়িৎ প্রশ্ন।

"হ্যাঁ, আছে আমার কাছেই!"- পন্ডিত ঝোলার ভেতর থেকে জুতার পাটি বের করে সবাইকে দেখালেন।

 

জুতা দেখে তো রাজার মাথা ঘুরতে আরম্ভ করলো। নিজের কপালে করাঘাত করে হুকুম করলেন মন্দির থেকে এক্ষুনি জুতার পাটিটি নিয়ে আসতে। তারপর উচ্চস্বরে বলতে লাগলেন, "আমরা তো এটাকে ভগবানের জুতা মনে করে কতো মাথায় ঠেকিয়ে, চুমু খেয়ে, চেটে চেটে চকচকে করে তুলেছি!"

 

পন্ডিত তখন মৃদু বললেন, "মহারাজ, একেই বলে অবিদ্যা। এই রাজ্য একদিন এমনি অবিদ্যায় ছেয়ে যাবে! অনেক মানুষের বুদ্ধিলোপ হবে। লোকে এতটাই নির্বোধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন আর ধর্মান্ধ হয়ে যাবে যে ভালো মন্দ ঠিক বেঠিকের ফারাক করতে পারবে না। আর এসব দেখে ভগবান অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা মানুষ সৃষ্টি করার জন্য মনে মনে আফসোস করবেন।"

 

সংগৃহীত

 


Post a Comment

Previous Post Next Post