টেলিফোন রেকর্ড আদালতে প্রমাণ হিসেবে: বাংলাদেশের আইনি প্রেক্ষাপট

 

প্রতীকী ছবি


বাংলাদেশের আদালতে টেলিফোন রেকর্ড প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন একটি জটিল ও সংবেদনশীল বিষয়। এটি আইনগত বৈধতা, সাক্ষ্য আইনের প্রাসঙ্গিক ধারা, ডিজিটাল প্রমাণের গ্রহণযোগ্যতা এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে নির্ভর করে। নিচে এ বিষয়ে আলোচনা করা হলোঃ

 

১।   রেকর্ডিংয়ের বৈধতা ও সম্মতি

বাংলাদেশে টেলিফোন রেকর্ডিং করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সম্মতি থাকা আবশ্যক। গোপনে রেকর্ড করা ফোনালাপ সাধারণত বেআইনি হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এটি ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করতে পারে।

 

২।  সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২: ধারা ৩২ ও ৬৫বি

ধারা ৩২: মৃত বা সাক্ষ্য দিতে অক্ষম ব্যক্তির বিবৃতি

সাক্ষ্য আইন ১৮৭২-এর ধারা ৩২ অনুযায়ী ‘যদি কোনো ব্যক্তি মারা যান বা সাক্ষ্য দিতে অক্ষম হন, তবে তার পূর্বের বিবৃতি বা জবানবন্দি প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে। টেলিফোন রেকর্ডিং যদি এমন ব্যক্তির বিবৃতি ধারণ করে, তবে তা এই ধারার আওতায় প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা যেতে পারে’।

 

ধারা ৬৫বি: ডিজিটাল রেকর্ডের গ্রহণযোগ্যতা

২০২২ সালের সংশোধনীর মাধ্যমে সাক্ষ্য আইনে ধারা ৬৫বি যুক্ত হয়েছে, যা ডিজিটাল রেকর্ডের গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারণ করে। এই ধারার অধীনে ডিজিটাল রেকর্ড (যেমন টেলিফোন রেকর্ডিং) প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে, যদি নিম্নলিখিত শর্তগুলো পূরণ হয়:

 

  • রেকর্ডটি যে কম্পিউটারে সংরক্ষিত হয়েছে, তা নিয়মিত ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
  • তথ্যটি কম্পিউটারে নিয়মিতভাবে সংরক্ষিত হয়েছে।
  • কম্পিউটারটি সঠিকভাবে পরিচালিত হয়েছে।
  • কোনো ইলেকট্রনিক প্রমাণ (যেমন: অডিও বা ভিডিও রেকর্ড) উপস্থাপন করার আগে, এটি ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করা হতে পারে, যা প্রমাণ করবে যে এটি আসল এবং টেম্পার করা হয়নি।
  • রেকর্ডটি একটি সার্টিফিকেটসহ উপস্থাপন করতে হবে, যেখানে রেকর্ড তৈরির প্রক্রিয়া, ব্যবহৃত ডিভাইস এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্য উল্লেখ রয়েছে।

 

৩।  আদালতের দৃষ্টিভঙ্গি ও পূর্ববর্তী রায়

বাংলাদেশের আদালতসমূহ বিভিন্ন মামলায় ডিজিটাল প্রমাণ, যেমন ভিডিও ফুটেজ, অডিও রেকর্ডিং ইত্যাদি গ্রহণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৮৫ সালের "খালেদা আক্তার বনাম রাষ্ট্র" মামলায় আদালত ভিডিও ক্যাসেটকে "ডকুমেন্ট" হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

 

৪।  ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ ও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬

এই আইনসমূহ ডিজিটাল প্রমাণের গ্রহণযোগ্যতা এবং সাইবার অপরাধের তদন্তের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে এগুলোর প্রয়োগ, ক্ষেত্র নির্দিষ্ট এবং সব ধরনের ডিজিটাল প্রমাণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

 

উপসংহার

বাংলাদেশের আইনে টেলিফোন রেকর্ড আদালতে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে, যদি:

  • রেকর্ডিংটি বৈধভাবে এবং সংশ্লিষ্ট সকলের সম্মতিতে করা হয়।
  • রেকর্ডটি মামলার সাথে প্রাসঙ্গিক এবং যুক্তিসঙ্গত হয়।
  • সাক্ষ্য আইন, বিশেষ করে ধারা ৩২ ও ৬৫বি-এর শর্তাবলী পূরণ করা হয়।
  • রেকর্ডটি একটি উপযুক্ত সার্টিফিকেটসহ উপস্থাপন করা হয়।

 

তবে প্রতিটি মামলার প্রেক্ষাপট ভিন্ন হতে পারে। তাই টেলিফোন রেকর্ড আদালতে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করার আগে একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post