আইউব খান থেকে এরশাদ পর্যন্ত সামরিক শাসনের ছদ্মবেশ এবং বর্তমান সময়ের অযৌক্তিক গণভোট পরিকল্পনা।
সৌভাগ্যক্রমে হোক অথবা দুর্ভাগ্যক্রমে, জীবনে তিনটি গনভোট পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়েছিল। প্রথমটি আবছা আবছা মনে থাকলেও এটুকু বুঝেছিলাম, ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বার চেয়ারম্যনরা ঢাকায় গিয়ে আইউব খানকে ‘হ্যাঁ’ ভোট দিয়ে ‘কাঠের বাক্স’সদৃশ একটি করে ১ ব্যান্ড রেডিও নিয়ে বাড়িতে ফিরেছিল। পরবর্তীতে ইতিহাসের হাস্যকর দুটি গনভোটের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ভোট প্রক্রিয়া অবলোকন করার সুযোগ হয়েছিলো।
নিবন্ধের পরবর্তী অংশ গুগল থেকে তথ্য নিয়ে লিখিতঃ
মূল নিবন্ধ:
আইউব খানের মৌলিক গণতন্ত্র (Basic Democracies), ১৯৫৯–১৯৬৯
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইউব খান সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা দখল করেন। সংসদ বিলুপ্ত, রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ও সংবিধান স্থগিত করেন।
১৯৫৯ সালে তিনি “Basic Democracies Order” জারি করে চার স্তরবিশিষ্ট স্থানীয় সরকারব্যবস্থা গঠন করেন—ইউনিয়ন, থানা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে। ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বলা হতো “মৌলিক গণতন্ত্রী” (Basic Democrat)।
এই ৮০ হাজার প্রতিনিধিরাই ১৯৬০ সালের তথাকথিত “গণভোটে” ভোট দেন—জনগণ নয়।
প্রশ্ন ছিল:
“আপনি কি প্রেসিডেন্ট আইউব খানের নীতিমালার প্রতি আস্থা রাখেন?” – হ্যাঁ/না
প্রায় শতভাগ আস্থা ভোটে আইউব খান নিজেকে বৈধ ঘোষণা করেন এবং ১৯৬২ সালের সংবিধানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও এদের মাধ্যমে করার বিধান দেন।
নেতিবাচক ফলাফল:
- জনগণের সরাসরি ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।
- রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ থাকায় নাগরিক রাজনীতি অবরুদ্ধ হয়।
- প্রশাসন হয়ে ওঠে কেন্দ্রীয় ও সামরিক প্রভাবাধীন।
- পূর্ব পাকিস্তানে গণঅসন্তোষ তীব্র হয়, যা পরিণামে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়।
শেখ মুজিবুর রহমান এই গনভোটকে বলেছিলেন:
“মৌলিক গণতন্ত্র নয়, এটি মৌলিক স্বৈরতন্ত্র।”
জিয়াউর রহমানের গণভোট, ৩০ মে ১৯৭৭
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর একাধিক সামরিক পরিবর্তনের ধারায় জিয়াউর রহমান ক্ষমতা নেন। সামরিক আইন তখনও বলবৎ।
১৯৭৭ সালে তিনি গণভোটের মাধ্যমে “জনসমর্থন” যাচাইয়ের ঘোষণা দেন।
প্রশ্ন ছিল:
“আপনি কি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে প্রবর্তিত জাতীয় কর্মসূচি ও নীতিমালার প্রতি আস্থা রাখেন?” – হ্যাঁ/না
সরকার ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী:
- ভোটার উপস্থিতি: প্রায় ৮৯%
- “হ্যাঁ” ভোট: প্রায় ৯৮.৮৭%
এতো বিপুল “সমর্থন” ছিল বাস্তবতার বাইরে। ভোটকেন্দ্রে সেনা তত্ত্বাবধান, বিরোধীদের নিষিদ্ধকরণ এবং প্রশাসনিক প্রভাব স্পষ্ট ছিল। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে যা দেখেছিঃ
- ভোটকেন্দ্রে ভোটার যেতে দেখিনি
- শহরে স্বাভাবিক দিনের মত লোক চলাচল ছিল না, শুন্য শহর
- বিকেল ৫ টার পর উপরের নির্দেশে ব্যালট বাক্স ‘হ্যাঁ’ ভোটে পূর্ণ করা হয়।
নেতিবাচক ফলাফল:
- জনগণের প্রকৃত মতামত জানার সুযোগ বিলুপ্ত।
- সামরিক বাহিনী রাজনীতিতে সরাসরি ভূমিকা নিতে শুরু করে।
- নির্বাচনী কারচুপি ও দলীয় প্রশাসনের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
- সংবিধানের সামরিক সংশোধনগুলোতে “রাষ্ট্রধর্মহীনতা ও ধর্মীয় রাজনীতি পুনঃপ্রবর্তন” শুরু হয়।
এই গণভোটের মাধ্যমে জিয়া “বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ” ধারণা প্রতিষ্ঠা করে রাজনৈতিক মঞ্চ প্রস্তুত করেন—যা পরে বিএনপি গঠনের ভিত্তি হয়।
এরশাদের গণভোট, ২১ মার্চ ১৯৮৫
১৯৮২ সালে সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন। তিনি নিজেকে “রাষ্ট্রপতি ও Chief Martial Law Administrator” ঘোষণা করেন এবং ১৯৮৫ সালে জনগণের “সমর্থন” যাচাইয়ের জন্য গণভোটের আয়োজন করেন।
প্রশ্ন ছিল:
“আপনি কি রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ঘোষিত নীতি, কর্মসূচি ও কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট?” – হ্যাঁ/না
সরকারি ফলাফল অনুযায়ী:
- ভোটার উপস্থিতি: প্রায় ৭২%
- “হ্যাঁ” ভোট: প্রায় ৯৪%
রাজনৈতিক দলগুলোর বর্জন। কারচুপি ও সরকারি প্রভাব এতটাই স্পষ্ট ছিল যে এই গণভোট আন্তর্জাতিকভাবে প্রহসনমূলক ভোট হিসেবে সমালোচিত হয়। প্রত্যক্ষদর্শী না শুধু ভোট প্রক্রিয়ার প্রারম্ভিক কিছু কাজের সাথে বাধ্যতামূলক সম্পৃক্ত থাকতে হয়েছিলো। কি ঘটেছিলো তা গোপনীয়তার স্বার্থে আমার পক্ষে অবর্ণনীয়।
নেতিবাচক ফলাফল:
- ভোট প্রক্রিয়ায় সেনা ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ স্বাভাবিক হয়ে যায়।
- গণমাধ্যম ও নাগরিক স্বাধীনতা সীমিত হয়।
- রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা করে এরশাদ ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি প্রাতিষ্ঠানিক করেন।
- ছাত্র ও শ্রমিক রাজনীতি দমন করে ক্ষমতাকে এককেন্দ্রিক করেন।
উপসংহার: গণতন্ত্রের নামে বৈধতা, ফল ছিল স্বৈরতন্ত্র
এই তিন শাসকের গণভোটের অভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল—সামরিক ক্ষমতার রাজনৈতিক বৈধতা অর্জন।
তাদের শাসন জনগণকে রাজনীতির কেন্দ্র থেকে সরিয়ে বুটের ছায়ায় জন্ম নেওয়া গণতন্ত্র উপহার দেয়।
এর ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হয়েছে, তা হলো—
- গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়ে পড়া
- বেসামরিক প্রশাসনে সেনা প্রভাব বৃদ্ধি
- ভয়ভীতির সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা
- রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাস ও বিভাজন
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চর্চা আজও সেই বিকৃত ঐতিহ্যের বোঝা বইছে—যেখানে “গণভোট” মানে জনগণের মতামত নয়, বরং শাসকের বৈধতা প্রাপ্তির এক রাজনৈতিক নাট্যমঞ্চ।
বর্তমান প্রস্তাবিত গণভোট: গণতন্ত্রের পথে নতুন বিভ্রান্তি
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাবিত ৮৪টি ধারার ওপর গণভোট ইতিহাসে অভূতপূর্ব, অকল্পনীয় এবং প্রতারণামূলক। লক্ষ্য করুন, উপরে যে ৩টি গনভোটের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো সবই মাত্র একটি ধারার উপর। তাছড়া তখনকার শাসন ব্যবস্থা আর এখনকার শাসন ব্যবস্থার অনেক পরিবর্তন এসেছে, সংবিধানে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমান সংবিধান স্থগিত করা হলে তার শাস্তি মৃত্যদণ্ড। উল্লেখ্য, আগের দুটি সামরিক শাসনও অবৈধ ঘোষণা করেছে সর্বোচ্চ আদালত।
বর্তমানে যে গনভোটের কথা বলা তা রাজনৈতিকভাবেও গভীরভাবে বিভাজনমূলক। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো ধারার পরিবর্তন সংসদীয় প্রক্রিয়াতেই হতে পারে—গণভোটে নয়। ফলে এমন উদ্যোগ বাস্তবে আইনগত অনিশ্চয়তা ও রাজনৈতিক সংকট আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। অতীতের মতোই এই গণভোটও যদি জনমতের পরিবর্তে ক্ষমতার বৈধতা অর্জনের মাধ্যম হয়ে ওঠে, তবে তা গণতন্ত্র নয়—বরং গণতন্ত্রের সাথে প্রতারণা।
উদ্ধৃতি / Reference:
- “Basic Democracies Order, 1959” – Government of Pakistan
- Bangladesh Government Gazette, 1977
- Bangladesh Election Commission Archives (1985)
- A. M. A. Muhith, Bangladesh: Emergence of a Nation, 1999
- Talukder Maniruzzaman, The Politics of Military Rule and the Dilemmas of Democratization, 1988
- জুলাই সনদ








Leave a Reply