১৫ জনের শাসন বনাম ১৮ কোটির অধিকার: বাংলাদেশের গণতন্ত্র আজ কোথায় দাঁড়িয়ে

১৫ জনের শাসনে ১৮ কোটি মানুষের গণতন্ত্র: বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট



প্রতীকী ছবি

ভূমিকা

বাংলাদেশ আজ এক অস্বাভাবিক ও সাংবিধানিকভাবে বিপজ্জনক সময় অতিক্রম করছে। যে রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক ১৮ কোটি জনগণ, সেই রাষ্ট্র বর্তমানে পরিচালিত হচ্ছে মাত্র হাতে গোনা ১৫ থেকে ২০ জন অনির্বাচিত ব্যক্তির ইচ্ছানুযায়ী। এই বাস্তবতা শুধু গণতান্ত্রিক কাঠামোর বিপর্যয় নয়, এটি সরাসরি জনগণের সার্বভৌম অধিকারকে অবমাননা করে।

গত দশ মাস ধরে ইউনিয়ন পরিষদ বাদেই দেশের প্রায় ৬,৭০০ জন নির্বাচিত প্রতিনিধি কার্যত অনুপস্থিত। প্রশাসনের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে রাষ্ট্রপতির অধীনে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে—রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজন সদস্য সীমা অতিক্রম করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এই ক্ষমতার অপব্যবহার একটি সাংবিধানিক লঙ্ঘনের উদাহরণ এবং কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়েও পড়ে।

 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সীমাবদ্ধতা এবং বাস্তবের বিচ্যুতি

বাংলাদেশের সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা উপদেষ্টা পরিষদের অস্তিত্ব নাই। সংকটকালিন সময়ে রাষ্ট্রপতির অধীনে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়েছে। সেটারও বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সুপ্রিম কোর্টের যে রেফারেন্সের কথা বলা হয়েছে তাতেও উপদেষ্টা পরিষদের এখতিয়ার স্পষ্টভাবে নির্ধারিত—তারা কেবল রাষ্ট্রপতিকে দৈনন্দিন প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে সহায়তা করবেন। নীতিনির্ধারণী কিংবা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার তাঁদের নেই।

কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এই উপদেষ্টাদের মধ্য থেকে গুটিকয়েক ব্যক্তি এবং প্রধান উপদেষ্টার ঘনিষ্ঠ সহকারীরা রাষ্ট্রপতিকে পাশ কাটিয়ে একের পর এক রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন—যা সম্পূর্ণভাবে সাংবিধানিক কাঠামোর বিরোধী এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

 

প্রতিনিধিত্বহীনতার হিসাব: সংখ্যাতাত্ত্বিক চিত্র

বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সংখ্যা ও ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে বর্তমান শূন্যতার প্রকৃত রূপ আরও স্পষ্ট হয়। নিচে একটি তালিকা দেওয়া হলো, যাতে পাঠকরা সহজে বিষয়টি অনুধাবন করতে পারেন:

জাতীয় ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের তালিকা (ইউনিয়ন পরিষদ বাদে):

১। সংসদ সদস্য (MP) – ৩৫০ জন
২। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান – ৬৪ জন
৩। জেলা পরিষদ সদস্য – ১,২৮০ জন
৪। সিটি কর্পোরেশন মেয়র – ১৩ জন
৫। সিটি কর্পোরেশন কাউন্সিলর (কমিশনার) – ৬৮১ জন
৬। পৌরসভা মেয়র – ৩২৯ জন
৭। পৌরসভা কাউন্সিলর – আনুমানিক ২,৫০০ জন
৮। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান – ৪৯৫ জন
৯। উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান – ৯৯০ জন

মোট: ৬,৭০২ জন জনপ্রতিনিধি (ইউনিয়ন পরিষদ ব্যতীত)


ইউনিয়ন পরিষদে প্রতিনিধিত্ব:
১০। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান – ৪,৫৭৯ জন
১১। ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য (যাদের সাধারণত কাউন্সিলর বলা হয়) – প্রায় ৪১,২১১ জন (প্রতিটি ইউনিয়নে সাধারণত ৯ জন সাধারণ সদস্য ও ৩ জন সংরক্ষিত নারী সদস্য)

এই বিশাল সংখ্যক জনগণের প্রতিনিধি বর্তমানে নিষ্ক্রিয় প্রায়। যার অর্থ, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী ও তৃণমূল পর্যায়ে প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থার কার্যক্রম পুরোপুরি স্থবির। যেতূকূ চালূ আছে তা পেশি শক্তির চাপে নৈতিকতার মান তলানিতে।

 

সাংবিধানিক অবক্ষয়: গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ছে

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন। আর সেই ইচ্ছা প্রতিফলিত হয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে। এই প্রতিনিধিদের অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রের পরিচালনার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। যাঁরা নির্বাচিত নন, তাঁদের দ্বারা জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার অধিকার নেই। এই ক্ষমতার অপব্যবহার রাষ্ট্রের সাংবিধানিক শৃঙ্খলা, জবাবদিহিতা ও সুশাসনকে ধ্বংস করছে।

এ অবস্থায় দেশের ভবিষ্যৎ ক্রমেই অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করছে এমন একটি গোষ্ঠী, যাঁরা জনআস্থার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নন এবং যাঁদের কর্মকাণ্ডে গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও নেই।

 

জনগণের মালিকানা পুনরুদ্ধার জরুরি

বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তার একমাত্র সমাধান হলো জনগণের প্রতিনিধিত্ব ফিরিয়ে আনা। একজন নাগরিকের মতামত প্রতিফলনের মাধ্যমই হলো নির্বাচন। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি ছাড়া কোনো শাসনব্যবস্থাই বৈধ নয়। এটি শুধুমাত্র সংবিধানের বিধান নয়, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ন্যূনতম শর্ত।

 

উপসংহার

আজকের বাস্তবতা আমাদের শেখায়, একটি রাষ্ট্র শুধুমাত্র আইন বা সংবিধান দিয়ে টিকে থাকে না—তার ভিত্তি হয় জনগণের আস্থা ও অংশগ্রহণের উপর। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্র এবং সংবিধানের মূল কাঠামো হুমকির মুখে। এই সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো:

  • দ্রুত, স্বচ্ছ ও সকল পক্ষের অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন
  • জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া

এটি কেবল একটি রাজনৈতিক দাবি নয়—এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রতি আমাদের সম্মিলিত অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন।

 


Post a Comment

Previous Post Next Post