![]() |
প্রতীকী ছবি |
শায়খুল হাদীসগণ প্রায়ই দাবি করে থাকেন
যে, আল্লাহ তাঁর রাসূলকে দুটি বিষয় দিয়েছেন—একটি কোরআন, আরেকটি হিকমা। এবং এই
হিকমাকেই তাঁরা সরলীকরণ করে হাদীস বলে প্রতিস্থাপন করেন। এর ফলে, আল্লাহ ও তাঁর
রাসূলের অনুসরণের নামে মানুষকে বাধ্য করা হয় এমন সব কথিত হিকমা মেনে নিতে, যেগুলোর
কোনো অনুমোদন কোরআন বা আল্লাহর রাসূল থেকে নেই—বরং এসব সংগৃহীত ও সংকলিত হয়েছে
ইরান, উজবেকিস্তান, কিংবা মধ্যযুগীয় অন্যান্য ভূখণ্ডের ইমাম ও মোহাদ্দেছিনদের
হাতে।
ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর—একজন
সম্মানিত চিন্তাবিদ, যিনি ‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’ বই লিখে প্রচলিত ওয়ায়েজীনদের
তোপের মুখে পড়েছিলেন—তিনিও এই হিকমা = হাদীস সমীকরণে বিশ্বাসী ছিলেন। কেন তিনি
এমনটা বলেছিলেন, তা একমাত্র তিনিই জানেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা
করি, তাঁর ব্যক্তিত্ব ও উপস্থাপনার মাধুর্যে মুগ্ধ। কিন্তু হিকমার ব্যাখ্যায় আমি
তাঁর সাথে একমত নই।
হিকমা:
কোরআনের পরিভাষায়
‘হিকমা’ শব্দের অর্থ ‘প্রজ্ঞা’,
ইংরেজিতে ‘Wisdom’। আমাদের নবী (সা.)-এর জীবন, আদেশ, নিষেধ—সবই এক প্রজ্ঞার আলোকে
পরিচালিত। কোরআনে বারবার বলা হয়েছে, আল্লাহ নিজেই হাকীম—অর্থাৎ পরম প্রজ্ঞাময়।
কিন্তু কোরআনেই যদি হিকমা না থাকে, তাহলে কোরআনের সাথে “হাকীম” বিশেষণ কি করে বসে?
শায়খুল হাদীসরা বলেন, হিকমা কোরআনে
নেই—হিকমা আছে বুখারী, মুসলিমে! অথচ কোরআন স্পষ্ট বলছে:
“উদ’উ ইলা-ছাবীলি রাব্বিকা বিল
হিকমাতি ওয়াল মাও’ইজাতিল হাছানা”
(আহবান করো তোমার রবের পথে প্রজ্ঞা ও সদুপদেশ দ্বারা) — সূরা নাহল, আয়াত
১২৫
আল্লাহ যদি আমাদের হিকমা না দিতেন,
তাহলে এই আয়াতের কী মানে দাঁড়ায়?
হিকমার
বাস্তব উদাহরণ: লোকমান (আ.)
কোরআনে হিকমার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য
চরিত্র হযরত লোকমান (আ.)। তিনি নবীও নন, কিন্তু আল্লাহ তাঁকে হিকমা দিয়েছেন:
“ওয়া লাকাদ আ-তাইনা-লুকমা-নাল হিকমা”
(আমি লোকমানকে হিকমা দিয়েছি) — সূরা লোকমান, আয়াত ১২
লোকমান (আ.) ছিলেন একজন
‘হাকীম’—কবিরাজ নন, বরং প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি। তাঁর হিকমা আমরা কোথায় পাবো? ‘লোকমান
শরীফ’ নামে তো কোনো হাদীসগ্রন্থ নেই! তার হিকমার একমাত্র উৎস হচ্ছে কোরআন—আর সুরা
লোকমান তারই বিজ্ঞাপন।
সুরাটি শুরুই হচ্ছে:
“আলিফ-লাম-মীম, তিলকা আয়াতুল কিতাবিল
হাকীম”
(এই আয়াতগুলো প্রজ্ঞাপূর্ণ কিতাবের আয়াত) — সূরা লোকমান ১-২
এখানে ‘হিকমাপূর্ণ কিতাব’ মানে কী?
বুখারী শরীফ না কোরআন শরীফ? একই রকম ঘোষণা সূরা ইয়াসিনেও আছে:
“ইয়া-সীন, ওয়াল কোরআনিল হাকীম”
(হিকমাপূর্ণ কোরআনের শপথ) — সূরা ইয়াসিন, আয়াত ১-২
হিকমার
বিপরীতে কোরআন-বহির্ভূত হাদীস?
সুরা লোকমানের ৬নং আয়াতে বলা হচ্ছে:
“ওয়া মিনান্নাসি মাইয়াশতারি লাহওয়াল
হাদীসি লিইউদিল্লা আন সাবিলিল্লাহি বিগাইরি ইলম”
(কিছু মানুষ আছে যারা অজ্ঞতাবশত আল্লাহর পথ থেকে সরানোর জন্য ‘অসার হাদীস’ ক্রয়
করে)
এই আয়াতে ‘লাহওয়াল হাদীস’ বলতে কি
বোঝানো হয়েছে? এর ব্যাখ্যা পরবর্তী আয়াতে পরিস্কার হয়ে যায়:
“যখন তার সামনে আমার আয়াত পাঠ করা হয়,
সে এমনভাবে মুখ ফিরিয়ে নেয় যেন কিছুই শুনছে না”
— সূরা লোকমান ৭
অর্থাৎ, যারা কোরআনের আয়াত উপেক্ষা
করে বানোয়াট ও অপ্রমাণিত বর্ণনাকে ধর্মের মূল উৎস বানায়, তাদের জন্য রয়েছে কঠোর
শাস্তির ঘোষণা।
লোকমান
(আ.)-এর হিকমা কী ছিল?
লোকমান তার পুত্রকে যেসব উপদেশ
দিয়েছেন, সেগুলোই হচ্ছে আল্লাহর দৃষ্টিতে প্রকৃত হিকমা:
- শিরক না করো –
শিরক মানে আল্লাহর সঙ্গে অন্য কিতাব বা বিধানকে সমান মর্যাদা দেওয়া।
- সালাত কায়েম করো –
সালাত মানে কোরআন কায়েম করা; সালাতে কোরআন পড়া হয়, হাদীস নয়।
- ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ – এটি ধর্মের মূল।
- ধৈর্য ধারণ করো –
বিপদে ধৈর্যই প্রকৃত বিশ্বাসের প্রমাণ।
- অহংকার কোরো না, নম্রভাবে চলাফেরা করো, নিচু স্বরে কথা
বলো – বিনয়ই প্রজ্ঞার মূল চিহ্ন।
- পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা – কিন্তু আল্লাহর শরীক হতে বললে তাদের অনুসরণ নয়।
এই উপদেশগুলোই হচ্ছে ইসলামি প্রজ্ঞার
সোনালী দিকনির্দেশনা, যা কোরআন ছাড়া আর কোথাও নেই।
ধর্ম মানে
কর্ম, অন্ধ অনুকরণ নয়
আজকের দিনে ধর্ম মানে হয়ে
দাঁড়িয়েছে—দাঁড়ি, টুপি, লম্বা জামা, কিংবা বিভিন্ন দিবস পালন। অথচ কোরআনে এসব নিয়ে
কিছু নেই। কোরআনে আছে– সততা, ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা, ন্যায়পরায়ণতা। হিকমা মানে এই
গুণাবলি। কোরআনের বাইরে গিয়ে যখন আমরা লোকগাঁথা, বানোয়াট হাদীস, আজগুবি তাফসিরে
ঝুঁকি নিই, তখনই ধর্ম হারায় তার আসল উদ্দেশ্য।
শিরক কেবল
মূর্তিপূজা নয়, কিতাবেও হয়
সুরা লোকমান জুড়ে বারবার বলা
হচ্ছে—আল্লাহর কিতাবই একমাত্র হিদায়াত। আর কোরআনের বাইরে বাপ-দাদার রেওয়াজ, ইমাম,
পীর, বা ওলি-আউলিয়ার বর্ণনাকে সমান মর্যাদা দিলে তা শিরকের শামিল হয়।
“তোমার পিতা-মাতা যদি তোমাকে এমন কোনো
বিষয়ে চাপ দেয় যা সম্পর্কে তোমার কোনো জ্ঞান নেই (অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিল
নয়), তবে তা মানবে না”
— সূরা লোকমান, আয়াত ১৫
উপসংহার:
প্রজ্ঞার পথে ফিরুন
কোরআন হচ্ছে আল্লাহর অফিশিয়াল জিপিএস।
এই হিকমাপূর্ণ কিতাবই আমাদের সঠিক গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে। যারা এই কিতাব বুঝে
পড়েন, তারা রবীন্দ্রনাথ বা সক্রেটিস পড়েও আলোকিত হন। যারা কোরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে
নেন, তারা কথায় কথায় গোমরাহ হয়। কেউ কিছু বললে বলে, “আমার আব্বা বলেছেন, এই হাদীস
সহীহ”। আরেকজন বলে, “ওটা জাল”। এভাবেই জন্ম নেয় বিভক্তি, জন্ম নেয় বিদ্বেষ।
তাই বলি—কোরআন পড়ুন, বুঝে পড়ুন। তারপর
হাদীস পড়ুন, ইতিহাস জানুন। কিন্তু কোরআনকে বাদ দিয়ে কিছুই ধরবেন না। কারণ, আল্লাহর
একমাত্র অনুমোদিত ধর্মীয় বিধান হচ্ছে “কিতাবুল হাকীম”—প্রজ্ঞাপূর্ণ এই
কিতাব।
(এই লেখাটি ইউটিউবে
সজল রোশনের বক্তব্য এবং তাঁর বই “Religious Mindset – নবীর প্রজ্ঞা” অবলম্বনে
রচিত।)
আরও পড়ুনঃ হাদীস সংগ্রহ, সংকলন ও সংরক্ষণের ইতিবৃত্ত
Post a Comment