আমরা নবীজীর (সা.) প্রজ্ঞা ও
জীবনাদর্শকে নিজেদের পছন্দ, সুবিধা এবং দলীয় আলেমদের ব্যাখ্যার আলোকে বিচার করি।
প্রকৃতপক্ষে আমরা কোরআন ও হাদীস নয়, বরং আমাদের প্রবৃত্তি ও পক্ষপাতের অনুসরণ করি।
আল্লাহ বলেন:
"তোমাদের জন্য তোমাদের রাসূলের মধ্যেই রয়েছে উত্তম আদর্শ।" (সূরা
আহযাব ৩৩:২১)
নবীজী (সা.)-কে আল্লাহ কোরআনের
পাশাপাশি দিয়েছেন হিকমা—প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, নৈতিক দৃঢ়তা ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা।
কোরআন, হাদীস, সীরাত ও ইসলামের ইতিহাসে নবীজীর এই হিকমার অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে।
কিন্তু আমাদের শায়খুল হাদীসরা প্রায়ই
দাবি করেন—"হিকমা মানেই হাদীস"। অথচ হাদীসে হিকমার বিবরণ থাকতে পারে,
তাতে পুরো হাদীসকে হিকমা বলে চালানো প্রকৃতপক্ষে এক রকম মূর্খতা।
হিকমা
মানে কী?
হিকমা মানে শুধুমাত্র কিছু স্মরণীয়
বাণী নয়। এটি বিশ্লেষণী ক্ষমতা, সত্য উপলব্ধির দক্ষতা, চিন্তা, যুক্তি, সহনশীলতা
এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়ার সক্ষমতা। কোরআনের ভাষায় প্রতিটি জনপদে আল্লাহ একজন
করে নবী পাঠিয়েছেন—তাদের মধ্যেই ছিলো সেই অঞ্চলের শ্রেষ্ঠতম প্রজ্ঞা।
এই প্রজ্ঞাবান নবীরাই মানবজাতিকে কেবল
আধ্যাত্মিক নয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নৈতিক ও নীতিগত শিক্ষাও দিয়েছেন।
বর্তমান সময়ে নবী না এলেও প্রজ্ঞাবান
মানুষ আসবেই। যারা মানবজাতির সম্ভাবনার নতুন দ্বার খুলবে—এমন বিজ্ঞানী, দার্শনিক,
চিকিৎসাবিদ, রাষ্ট্রনায়ক বা সাহিত্যিকরাই নবীদের আদর্শের উত্তরসূরি। কিন্তু আমরা
আজ মদিনা, আল-আযহারের কিছু আলেম ছাড়া আর কাউকে "জ্ঞানী" বলে স্বীকৃতি
দিই না। হার্ভার্ড, অক্সফোর্ডে পড়া লোকজনকে আমরা ধর্মের বাইরে রাখি। একজন কবি,
চিন্তাবিদ, পদার্থবিদ, চিকিৎসাবিদ কি তবে জাহেল?
আহাম্মকির
উৎপত্তি: ধর্ম বনাম বুদ্ধিবৃত্তি বিচ্ছেদ
আজ আমরা ধর্মকে কেবল কিছু রীতিনীতি ও
লোকাচার রূপে দেখছি। আমাদের তথাকথিত আলেমরা বলেন—মৌচাক কতটা বড় হতে পারে, পানি পান
করতে হবে কোন হাতে, কোন দোয়ার ফলে বেহেশতের আটটি দরজা খুলে যাবে ইত্যাদি। অথচ
নবীজীর হিকমা ছিলো মানুষ গঠনের দর্শন—ন্যায়, দয়া, বিনয় ও দূরদর্শিতার পূর্ণরূপ।
আমরা কোরআন, হাদীস, সীরাতের সেই
প্রজ্ঞার রত্নভান্ডার দূরে ঠেলে হিকমা শব্দটিকে বানিয়েছি একগুচ্ছ অপ্রাসঙ্গিক কথার
সমষ্টি। এর কারণ একটাই—আল্লাহ নবীকে দিয়েছেন হিকমা, আর আমাদের দিয়েছেন আহাম্মকি।
ওয়াল্টার লিপম্যান বলেছিলেন:
“It requires wisdom to understand wisdom.”
“The music is nothing if the audience is deaf.”
আমাদের অবস্থা এই শ্রোতা-প্রবৃত্ত
শ্রেণির মতো, যারা নবীর হিকমা ও আবু জাহেলের হিকমার মধ্যে পার্থক্যই করতে জানে না।
ইতিহাস ও
কোরআনের সাক্ষ্য
আল্লাহ কোরআনে বলেন:
“ইব্রাহীম ও তার সাথীদের মাঝে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ।” (সূরা
মুমতাহিনা ৬০:৪)
কিন্তু এই উত্তম আদর্শ আমরা কোথা থেকে
জানবো? "সহীহ ইব্রাহীম শরীফ" নামে কোনো বই কি আছে জগতে? না, কোরআনেই আছে
সুরা ইব্রাহীম, সুরা আম্বিয়া, সুরা হুদ, সুরা ইউসুফ, সুরা নূহ—যেখানে নবীদের জীবনী
বর্ণিত।
ইব্রাহীম (আ.) কোরআনে প্রার্থনা করছেন—
"হে আমার রাব্ব! আমাকে প্রজ্ঞা দান করুন এবং সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গে আমার
মিলন ঘটান" (২৬:৮৩)
কিন্তু আমরা তার প্রজ্ঞা নয়, শুধু তার
"সুন্নতে খৎনা"কে জীবনের মূলমন্ত্র বানিয়েছি। অথচ কোরআনে ৬৯ বার
ইব্রাহীম (আ.)-এর নাম থাকলেও কোথাও তার খৎনার কথা নাই। খৎনার কথা এসেছে শুধু হাদীসে,
সেটাও উপসর্গরূপে। অথচ মুসলমানি শব্দটাই আজ খৎনার সমার্থক হয়ে গেছে!
কোরআনের
‘দোয়া শিক্ষা’ বনাম হাদীসের 'পাসওয়ার্ড' খোঁজা
নবীজী (সাঃ) দুঃসময় ও অস্থিরতার মধ্যে
আল্লাহর কাছ থেকে দোয়া শিখে নিয়েছেন। যেমন:
"রাব্বি আদখিলনী মুদখালা
সিদক..." (১৭:৮০)
এই দোয়াই মদিনায় তার বিজয়ের চাবিকাঠি।
কিন্তু আমরা এসব দোয়া উপেক্ষা করে আবু হুরায়রা থেকে আবু কুরায়জা, সাত পুরুষের
বর্ণনাসমেত দোয়া খুঁজি। কোরআনের দোয়াকে যথেষ্ট মনে করি না। কারণ, আমরা প্রজ্ঞাবান
নই।
দাঁড়ি,
টাখনু আর দুর্বল ব্যাখ্যার ফাঁদে আটকে পড়া ধর্মচর্চা
নবীজীর দাড়ি ছিলো। কিন্তু কোরআনে দাড়ি
রাখার কোনো নির্দেশ নাই। তবুও দাড়িকে আমরা বানিয়ে ফেলেছি প্রধান অনুকরণীয় সুন্নাহ।
আবার টাখনুর নিচে কাপড় ঝুলিয়ে পরা নিয়ে বিশাল ফতোয়া, অথচ হাদীসে বলা আছে:
"যারা অহংকারবশতঃ কাপড় ঝুলিয়ে পরে, আল্লাহ তাদের পছন্দ করেন না।"
(সহীহ হাদীস)
এখানে মূল শব্দ "অহংকারবশতঃ"।
কিন্তু এই প্রেক্ষাপট বাদ দিয়ে কাপড়ের দৈর্ঘ্য নির্ধারণকেই বানিয়ে ফেলেছি ঈমানের
মানদণ্ড।
নবীজীর
হিকমা: ক্ষমা ও কৌশলের মহাকাব্য
মক্কা বিজয়ের সময় নবীজী (সা.) ঘোষণা
করেন:
"যারা আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নেবে, তারা নিরাপদ।"
যে আবু সুফিয়ান ছিলো তার জীবনের
দীর্ঘতম শত্রু, তাকেই বানালেন প্রধান মিত্র। তার ছেলে মুয়াবিয়া হলেন মুসলিম খলিফা।
এমনকি আবু জেহেলের পুত্র ইকরিমাও, যিনি হারাম শরীফের ভিতরে মুসলিমদের আক্রমণ করেন,
তাকেও ক্ষমা করে নবীজী বলেন:
“সে আসছে, কেউ যেন তার বাবাকে গালি না
দেয়।”
এই ইকরিমাই পরবর্তিতে রোমানদের
বিরুদ্ধে ‘ইয়ারমুকের যুদ্ধে’ অতিমানবীয় সাহসিকতা দেখিয়ে মুসলিম বাহিনীর প্রধান
সেনাপতি হন।
এই হিকমা
কোথায় হারালো?
আজ আমরা নবীজীর জীবনাদর্শ বলতে
বুঝি—বগলের নিচের পশম, কুলি কিভাবে করতে হবে, টাখনুর ওপরে কাপড়, ঊটের মূত্র। অথচ
কোরআনের নবীজী হলেন—ক্ষমার বাতিঘর, বিনয়ের প্রতিমূর্তি, ন্যায়নীতির প্রতিচ্ছবি,
দয়ার এক জীবন্ত নিদর্শন।
উপসংহার
নবীজী বলেন:
“তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী।” (সহিহ
বুখারী হাদীস নং ৫০২৭)
প্রিয় পাঠক, নবীজী (সা.)-এর হিকমা
ছিলো এমন এক প্রজ্ঞা যা যুদ্ধের শত্রুকেও মিত্রে পরিণত করে। আর আমরা তার প্রজ্ঞাকে
সংক্ষিপ্ত করে এনেছি দাঁড়ির দৈর্ঘ্যে, মেসওয়াকের গাছের প্রকারে, দোয়ার উচ্চারণের
টানে।
আসুন, কোরআনে ফিরে যাই। নবীর হিকমাকে
আমাদের জীবনের মাপকাঠি বানাই। হিকমার আলোয় নিজেদের অন্ধত্ব কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা
করি। যেন আমাদের চিন্তা, চরিত্র ও কর্মে নবীদের সেই হিকমার ঝলক প্রতিফলিত হয়।
আরও পড়ুনঃ (১) হিকমা মানেই কি হাদীস?
(২) হাদীস সংগ্রহ, সংকলন ও সংরক্ষণের ইতিবৃত্ত
সূত্র:
- পবিত্র কোরআন
- সহীহ হাদীস
- সজল রোশনের ভিডিও ও ভাবনা
- বিভিন্ন ক্লাসিক প্রজ্ঞাবান মনীষীদের উক্তি
Post a Comment