‘আজকের এই লেখায় তুলে
ধরবো, হাদীস সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও এর শ্রেণীবিন্যাস সম্পর্কিত তুঘলকি কান্ডকারখানা
নিয়ে এবং এর নির্মম বাস্তবতা নিয়ে কথা বলবো পর্যায়ক্রমে’।
![]() |
প্রতীকী ছবি |
হাদীস বনাম কোরআন: প্রমাণ, প্রভাব ও প্রতারণা
ইসলামী শরীয়ায় কোরআনের পর ‘অপরিহার্য উৎস’ হিসেবে হাদীসকে প্রতিষ্ঠার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা কতটা স্বতঃসিদ্ধ আর কতটা জোরপূর্বক, সেটি আজও প্রশ্নসাপেক্ষ। 'হাদীস' শব্দটি কখনো 'সহায়ক', কখনো 'বিশ্লেষণ', আবার কখনো 'সম্পূরক' হিসেবে ব্যবহৃত হলেও, বাস্তবে বহু ক্ষেত্রেই কোরআনের সমকক্ষ একটি শরীয়ত উৎস হিসেবে এর প্রতিষ্ঠা এক ধরনের ঐতিহাসিক দখলদারিত্বের বহিঃপ্রকাশ—যা অনেকটা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতোই কৌশলে ইসলামী মননে আধিপত্য বিস্তার করেছে। কেউ এ নিয়ে মুখ খোলেন, কেউ আবার নীরব থাকেন ‘ব্যবসায়িক’ কারণে।
আরববাসীরা নবীজীকে প্রশ্ন করতেন: “কোরআন সত্য কিনা তা আমরা কিভাবে বুঝবো?”। আল্লাহর জবাব ছিল:
“তারা যদি সত্যবাদী হয়, তবে এর মতো একটি আয়াত নিয়ে আসুক” — (সূরা আত্-তূর ৫২:৩৪)।
প্রশ্ন হতে পারে, কোরআনের মতো আয়াত তৈরি করা কেন অসম্ভব? এর প্রকৃত জবাব একমাত্র আল্লাহই জানেন। তবে মানব ইতিহাসের গত দেড় সহস্রাব্দ ধরে যত পরাশক্তি ইসলামের বার্তা বিকৃত করতে চেয়েছে, কেউই কোরআনের একটি হরফও পরিবর্তন করতে পারেনি। একে অলৌকিকতা বলুন বা ঐশী নিরাপত্তা—এটা বাস্তবতা।
অপরদিকে, হাদীস বিষয়ক বিভ্রান্তি, বিকৃতি, ও বানানো কথার জগৎ এতই জটিল ও বিশৃঙ্খল যে, ইসলামের শুরু থেকেই এই বিষয়ে গভীর দ্বিধা ও মতপার্থক্য চলমান। যদি হাদীসও কোরআনের মতো ‘ওহী’ হতো, তাহলে চেঙ্গিস খান, গজনী, কিংবা সাম্প্রতিক ধর্মব্যবসায়ীরাও কোনো হাদীস গড়তে পারতো না। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করে, তারা সবাই পেরেছে।
হাদীস সংগ্রহের সূচনা ও প্রথম সংকট
নবীজীর জীবদ্দশায় হাদীস সংরক্ষণ ছিল বিক্ষিপ্ত। কেউ মুখে মুখে, কেউ বা নিজে লিখে রাখতেন। নবীজীর মৃত্যুর পর পরিস্থিতি একেবারেই বদলে যায়। নিজের প্রভাব প্রমাণে অনেকেই ‘নবীজী বলেছেন’ বলে বানোয়াট কথা প্রচার করতে শুরু করেন। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে হাদীস হয়ে ওঠে প্রভাব বিস্তারের একটি হাতিয়ার। এমনকি নবীজীর সাহচর্যে থেকেছেন এমন অনেক সাহাবীর কথাও বিকৃত হয়। ফলে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে লক্ষ লক্ষ হাদীস, যাদের সিংহভাগই যাচাইবিহীন।
ইমাম মালেক ও মুয়াত্তা: যাচাইয়ের শুরু
নবীজীর মৃত্যুর প্রায় এক শতক পরে ইমাম মালেক (জ. ৯৩ হিজরি) ‘মুয়াত্তা মালেক’ সংকলন করেন। প্রায় ১ লক্ষ হাদীস থেকে তিনি বাছাই করে মাত্র ১৮০০টি হাদীস তার গ্রন্থে স্থান দেন। বাকি ৯৮ হাজার হাদীস তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। তার এই সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন সচেতন বাছাইয়ের প্রমাণ, অন্যদিকে হাদীসের বিশাল ভাণ্ডারের বিপুল অংশ যে অগ্রহণযোগ্য, সেটিও স্পষ্ট করে।
এই ১৮০০ হাদীসের মধ্যেও মাত্র ৬০০টি সরাসরি নবীজীর (মারফু) কথা-কাজ। বাকি হাদীসগুলো সাহাবী বা তাবেঈদের মতামত (মউকুফ ও মাকতু)। এক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগে—কোরআনে যাদের নামই নেই, তাদের কথা কিভাবে কোরআনের সমকক্ষ শরীয়ত হয়?
ইমাম আবু হানীফা বনাম ইমাম মালেক
ইমাম মালেকের চেয়ে ১৩ বছর আগে জন্ম নেয়া ইমাম আবু হানীফা হাদীসের গ্রহনযোগ্যতা নিয়ে ভিন্ন অবস্থানে ছিলেন। মালেকী মতে রক্ত বের হলে ওজু ভাঙে না, হানাফী মতে ভাঙে। প্রশ্ন হলো—একই ধর্মে এমন দ্বিমুখী বিধান কীভাবে যুক্তিসঙ্গত?
হাদীস সংকলনের বিস্ফোরণ: বুখারী-মুসলিম ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব
ইমাম বুখারী (জ. ১৯৪ হিজরি) প্রায় ৬ লক্ষ হাদীস থেকে মাত্র ৭ হাজার হাদীসকে সহীহ হিসেবে ‘সহীহ বুখারী’তে স্থান দেন। এতে পুনরাবৃত্তি বাদ দিলে ইউনিক হাদীস মাত্র ২২৩০টি, যারও সবগুলো নবীজীর হাদীস নয়।
ইমাম মুসলিম, ইমাম তিরমিজী, ইমাম নাসাঈ—তিনজনই ইমাম বুখারীর ছাত্র হয়েও তাঁদের হাদীস নির্বাচনে গুরুতর পার্থক্য করেছেন। ইমাম মুসলিম এমন ৬০০ রাবীর হাদীস গ্রহণ করেছেন যাদের ইমাম বুখারী বাতিল বলে বিবেচনা করেছেন। তাহলে ‘সহীহ হাদীস’ নির্ধারণের মানদণ্ড কি আসলেই নিরপেক্ষ?
তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব এবং ফতোয়ার রাজনীতি
‘এই হাদীস সহীহ, এই জাল’—এই শ্রেণিবিন্যাসের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে সুন্নী ইসলামের চারটি প্রধান মাযহাব। কিন্তু বাস্তবে হাদীসের স্বীকৃতি অনেকাংশেই ইমামদের মাযহাবগত অবস্থান, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং ভৌগোলিক প্রভাবের ওপর নির্ভর করে।
ইবনে তাইমিয়া ও পরবর্তীতে ইবনে আব্দুল ওয়াহাবের হাতে গড়া ওহাবী মতাদর্শ সৌদি আরবের বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত গড়ে দেয়। বৃটিশরা এই মতাদর্শকে ইসলামি খেলাফত ধ্বংসে ব্যবহার করে। ফলত, ওহাবী মুফতিরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ‘জেহাদী ফতোয়া’ দেয়—যা মুসলিম সমাজে বিশাল বিভক্তি সৃষ্টি করে।
কোরআন বনাম হাদীস: শরীয়ার একমাত্র উৎস কে?
আসলে ইসলামি শরীয়ার একমাত্র অবিকল্প উৎস কোরআনই। হাদীস, ইতিহাস বা তাফসির আমাদের জ্ঞানের পরিপূরক হতে পারে, তবে আইনি উৎস নয়। ইমাম মালেক নিজেই বলেছেন, “আমি এই হাদীস স্বীকার করছি, কিন্তু আমল করছি না—কারণ এটি কোরআনের মূলনীতির পরিপন্থী।” অর্থাৎ হাদীসকে পরিপূরক বলা যায়, কোরআনের সমকক্ষ নয়।
আজকের বাস্তবতা ও করণীয়
বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই ধর্মীয় মতাদর্শকে কেন্দ্র করে মাজার, তাবলীগ, আহলে হাদীস ও আহলে সুন্নত পরস্পরকে ফতোয়া দিচ্ছে। কেউ বলছে মাজার মানেই শিরক, কেউ বলছে মাজারের রক্ষণাবেক্ষণ কর্তব্য। অথচ ইসলামের এই বিভাজনের মূলে যে হাদীসের অন্ধ ব্যবহার এবং ভ্রান্ত ব্যাখ্যা—সেই বিষয়ে কেউ স্পষ্ট উচ্চারণ করছে না।
হাদীস না থাকলে ইসলাম ধ্বংস হয়ে যাবে—এমন ধারণা কোরআনের পরিপন্থী। কারণ, কোরআন নিজেই বলেছে:
“হাদীস বর্ণনাকারী হিসাবে আল্লাহর চেয়ে আর কে বেশি সত্যবাদী?” – (সূরা নিসা ৪:৮৭)
উপসংহার
হাদীস এক মূল্যবান ঐতিহাসিক উৎস, কিন্তু কোরআনের বিকল্প নয়। শত সহস্র হাদীস যাচাই-বাছাইয়ের পরেও সর্বসম্মতিক্রমে ‘সহীহ’ হাদীসের সংখ্যা দুই-তিন হাজারের বেশি নয়। এরমধ্যে বহু হাদীস আবার কোরআনেরই আয়াতের ব্যাখ্যা বা পুনরাবৃত্তি। সুতরাং কোরআনকে মানলে সেগুলোকেও মানা হয়। শরীয়তের নাম করে হাদীসের অবাধ ও অন্ধ ব্যবহার ইসলামকে যতটা শক্তিশালী করেনি, দুর্বলই করেছে বেশি।
কোরআনই একমাত্র পূর্ণাঙ্গ, চূড়ান্ত, নির্ভুল ও অপরিবর্তনীয় গ্রন্থ—ইসলামের একমাত্র ভিত্তি। বাকিগুলো বিশ্লেষণ, ঐতিহাসিক দলিল কিংবা মতবাদ মাত্র। হাদীসের ছায়ায় শরীয়ত নির্মাণ নয়, বরং কোরআনের আলোয় সুন্নত অনুধাবনই হবে ইসলামের যথার্থ চর্চা।
Post a Comment