ধর্ম, বিজ্ঞান ও যুক্তির নামে বিভ্রান্তি: একটি আত্মজিজ্ঞাসা


প্রতীকী ছবি



ধর্ম, বিজ্ঞান ও যুক্তির নামে বিভ্রান্তি: একটি আত্মজিজ্ঞাসা

বর্তমান সময়ে ধর্ম নিয়ে কথা বলা যেন এক দুঃসাহসিক অভিযানে নামা। কারণ ধর্মীয় আলোচনা এখন শুধু ধর্মপ্রাণ কিংবা নাস্তিকদের দ্বন্দ্বে আটকে নেই—বরং এটি শাখায় শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে: আস্তিক-নাস্তিক, হিন্দু-মুসলিম, তারপর শিয়া-সুন্নি, আহলে হাদিস-আহলে সুন্নাহ—এবং বিতর্কের অন্ত নেই। তবে মন দিয়ে লেখাটি পড়লে—আপনি যেই মতের অনুসারীই হোন না কেন—একটা গভীর ভাবনার জন্ম হবেই।

 

হ্যাঁ, আপনি হয়তো বিনোদিত হবেন না। কিন্তু চিন্তায় সমৃদ্ধ হবেন—এটা নিশ্চিত। আমি কোনো ধর্ম প্রচারক নই। আমার উদ্দেশ্য কারও বিশ্বাসকে আঘাত করা নয়; বরং আমরা ধর্মের নামে কীভাবে নিজেরা বিভ্রান্ত হচ্ছি এবং অন্যদের বিভ্রান্ত করছি, সেটাই বিশ্লেষণ করা।

 

আপনি যদি নিচের ভিডিওটা (যদি থাকে) মন দিয়ে দেখেন, তাহলে বুঝতে পারবেন—ধর্মের ‘কোর বিউটি’ বা মৌলিক সৌন্দর্য আসলে কী। সেটাই এই লেখার মূল বিষয়।

 

ধর্মীয় কোনো বক্তব্যকে আমরা বৈজ্ঞানিক না অবৈজ্ঞানিক হিসেবে বিবেচনা করি আমাদের মনমানসিকতা ও বিশ্বাস অনুসারে। কেউ বিশ্বাস করে আল্লাহ আছেন, ফেরেশতা আছেন, পরকাল আছে—কারণ তাকে তাই শেখানো হয়েছে। কিন্তু এগুলো কি জ্ঞান (knowledge)? না, এগুলো বিশ্বাস (faith)। কারণ এগুলোর কোনো প্রমাণ আমাদের হাতে নেই।

 

আমরা জানি আমাদের দুটি হাত আছে, এজন্য আমরা বলি না "আমি বিশ্বাস করি, আমার দুটি হাত আছে"—আমরা জানি। কিন্তু আল্লাহ, ফেরেশতা, জান্নাত, দোজখ—এসব সম্পর্কে বলা হয়েছে: "বিশ্বাস করো", "জানো" নয়।

“Absence of evidence is not evidence of absence”—প্রমাণ না থাকাটা কোনো কিছুর অস্তিত্বের অভাবের প্রমাণ নয়।

 

ধর্ম যদি প্রমাণনির্ভর হতো, তাহলে আর বিশ্বাস বলে কিছু থাকতো না। বরং, ধর্ম এমন এক জগৎ—যেখানে ‘faith is stronger than fact’, ‘myth is stronger than history’, ‘imagination is better than knowledge’।

 

"সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি"—এটা কি তথ্য? না, এটা এক নিখাদ বিশ্বাস—দেশপ্রেম। ঠিক তেমনি, ধর্মও এক গভীর বিশ্বাস—যার মূল হচ্ছে আত্মনিয়ন্ত্রণ, সংযম, সহনশীলতা।

 

নিউ ইয়র্কে আজান হলে মুসলিমরা ডাবল পার্ক করে নামাজ পড়ে, অথচ কেউ পার্কিং টিকিট দেয় না। অন্য সময়ে সেটা করলে গাড়ি টেনে নিয়ে যাবে। ধর্মের এই সম্মান তৈরি হয় সমাজে পারস্পরিক শ্রদ্ধার মাধ্যমে।

 

আমরা যদি অপরের বিশ্বাসকে সম্মান না করি, তাহলে নিজের ধর্মের প্রতিও অন্যদের সম্মান আশা করতে পারি না।

 

এখন ‘বিজ্ঞান দিয়ে ধর্ম যাচাই’-এর প্রবণতা বেড়েছে। রোজার ফজিলত বোঝাতে ‘অটোফ্যাজি’ বলা হয়, অথচ কেউ রমজান বাদ দিয়ে রবিউল আউয়ালে উপোস রাখলে তো ফরজ আদায় হয় না! তাহলে উপোস আর রোজা এক জিনিস নয়।

 

এই ধরনের ‘পপুলার সায়েন্স’ দিয়ে ধর্মকে ‘বুঝে’ ধর্মপ্রেমিক হয়ে উঠা অনেক সময় বিপজ্জনক। যুক্তি শেষ হলে শুরু হয় গালাগালি, তারপর হাতাহাতি। এমনকি কেউ এসে বলবে—“খালি হাতে কেন, অস্ত্র ধরো!”

 

এইভাবে ধর্মের নামে উগ্রতা ছড়িয়ে পড়ে। ট্রাম্প, মোদির উত্থান কিংবা হোলি আর্টিজান-পরবর্তী পুরো সমাজে আলেম-ওলামা, মাদ্রাসা ছাত্রদের হয়রানির শিকারে পরিণত হওয়া—এসব তার পরিণতি।

 

টুইন টাওয়ার হামলার পর বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি নিরীহ মুসলমান কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা ভাবুন। অথচ হামলাকারীদের গর্বের সঙ্গে মুসলিম বলে দাবী করাই ইসলামকে সবচেয়ে বড় অপমান।

 

সুতরাং, ধর্মের সৌন্দর্য ও শক্তি তার মানবিক, নৈতিক ও নান্দনিক দিকেই নিহিত। যুক্তি ও বিজ্ঞানের নামে তার অপব্যাখ্যা করে আমরা শুধু ধর্ম নয়, সমাজকেই বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছি।

 

ধর্ম, আত্মোন্নয়ন ও মূল্যবোধ: একটি বিবেকের সন্ধান

হ্যাঁ, আমি জানি—এই মুহূর্তে আপনি হয়তো হাদীসের কয়েকটা স্ক্রিনশট দেখিয়ে বলবেন, “এই তো প্রমাণ!” কিন্তু আমি আগেই বলেছি—প্রায়োরিটি ও পরিণতি গুরুত্বপূর্ণ। খাবারে লবণ লাগবেই, কিন্তু এক কেজি মাংসে তিন কেজি লবণ দিলে তো গোটা খাবারটাই নষ্ট হয়ে যায়।

 

আজকাল সারাবিশ্বে মানুষ আত্মউন্নয়নের জন্য ধ্যান ও “Law of Attraction” অনুশীলন করে। এখানে আসল বিষয় একটাই—আপনি নিজের ভেতর কী ধরনের পরিবর্তন আনছেন? পজিটিভ না নেগেটিভ? আপনি নিজের ভেতরে যা লালন করবেন, সেটাই স্থায়ী হবে। এই কারণে ইতিবাচক লক্ষ্য নির্ধারণ করা অত্যন্ত জরুরি। না হলে নেতিবাচকতাই চিরস্থায়ী হয়ে উঠবে।

 

একজন মানুষ নামাজে দাঁড়াচ্ছেন—দেখানোর জন্য, লোক ঠকানোর জন্য—তাহলে সেই ঠকবাজিটাই তার চরিত্রে স্থায়ী হবে। দাড়ি রেখেছেন, টুপি পরেছেন, শুধু লোক ঠকানোর জন্য—তবে সে আর কখনো সৎ হতে পারবেন না।

 

আলেম-ওলামাদের আসল দায়িত্ব হওয়া উচিত—“কী আউটকাম হচ্ছে” সেটা বোঝানো। রমজানে কোন দোয়া পড়লে কত নেকি হয়, তা শেখানোর চেয়েও জরুরি—রমজান রাখার মূল উদ্দেশ্যটা বোঝানো। সংযম মানে ঠিক কী? তা থেকে কী পরিবর্তন আমরা নিজের মধ্যে আনবো?

 

নবীজী “নূরের তৈরি না মাটির তৈরি”, রওজায় “জীবিত না মৃত”—এসব আল্লাহই ভালো জানেন। আমাদের এসব নিয়ে বিতর্কে সময় নষ্ট করার দরকার নেই। আমাদের দরকার তাঁর জীবনচরিত থেকে শিক্ষা নেওয়া—সীরাতকে বুঝে জীবনে বাস্তবায়ন করা।

 

কমান্ডো ইউনিফর্ম পরলেই কেউ কমান্ডো হয় না। ঠিক তেমনি, নবীর পোশাক পরলেই কেউ নবীর উম্মত হয়ে যান না। কারণ একই পোশাক তো নবীজীর দুশমনরাও পরতেন। প্রায়োরিটি না বোঝার কারণেই আমরা গুরুত্বহীন বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছি।

 

একজন হয়তো গলা চড়িয়ে বলবেন:
“কোরআনে ৮২ বার নামাজের কথা এসেছে! দাড়ির কথা না থাকলেও হাদীসে তো আছে! বুখারিতে না থাকলেও বায়হাকিতে আছে, ‘ফাযায়েলে আমাল’-এ আছে...” ইত্যাদি।

 

হ্যাঁ ভাই, কোরআনে ৬ হাজারেরও বেশি আয়াত আছে। আপনি কেবল ২০–২৫টা আয়াত, ৫০টা হাদীস আর কয়েকটা গল্প কুড়িয়ে নিয়ে নিজের মতো করে ধর্মের একটা দোকান সাজিয়ে বসেছেন। অন্ধকে হাতী দেখানোর গল্প মনে আছে তো?
কেউ হাত ধরিয়ে বলছে, হাতী হচ্ছে সাপের মতো।
কেউ কান ধরিয়ে বলছে, হাতী হচ্ছে কুলারের মতো।
আর কেউ বলছে, হাতী হচ্ছে গাছের মতো।

সবাই নিজের সুবিধামতো ব্যাখ্যা দিচ্ছে।

 

আজকের দিনে কিছু তথাকথিত নাস্তিকও ঠিক একই কাজ করছে। তারাও শ’খানেক আয়াত আর হাদীস মুখস্থ করে নায়েক সাহেবের মতো রেফারেন্স দিয়ে কথা বলে। সুরা নিসার অমুক আয়াত, আবু দাউদ শরীফের তমুক হাদীস…। যেন সবাই নিজ নিজ ধর্ম-বিরোধী দোকানের ভিড় বাড়াতে ব্যস্ত। দোকানে দানবাক্স তো আছেই।

 

মানুষের দানের টাকায় তৈরি হচ্ছে প্রাসাদোপম মসজিদ ও মন্দির। অথচ সেখানে সাধারণ মানুষের অধিকার উপেক্ষিত।
স্বর্ণখচিত, মার্বেল পাথরের মসজিদ বানিয়ে আল্লাহকে খুশি করতে চাই? আল্লাহ কি আমাদের এই ‘স্বররণ’ আর ‘স্বেতপাথরের’ কাঙাল?

 

একটা বড় আলেমকে যদি জিজ্ঞেস করেন, “মসজিদের আসল কাজ কী?”, হয়তো বলবেন—শুধু শুক্রুবারের নামাজ পড়া।
কিন্তু সত্যিই কি তাই?

একটা আদর্শ মসজিদে—

  • পথিক বিশ্রাম নেবে,
  • অসহায় মুসাফির ঘুমাবে,
  • দানের টাকা দিয়ে ক্ষুধার্ত মানুষ খাবে,
  • বয়স্কদের শিক্ষার ব্যবস্থা হবে,
  • শিশুদের শিক্ষার সুযোগ থাকবে,
  • থাকবে উন্মুক্ত টয়লেট, পাবলিক লাইব্রেরি।

অথচ বাস্তবে দেখা যায়—নামাজের সময় ছাড়া তালা ঝুলে থাকে। বড় হরফে লেখা থাকে—“মসজিদে দুনিয়াবি কথা বলা হারাম।”
মসজিদে তালা দিয়ে আমরা মসজিদের ‘পবিত্রতা রক্ষা করি’—এই যুক্তি নিজেরাই বিশ্বাস করি না।

 

কাজী নজরুল লিখেছিলেন—

"ভুখারি ফিরিয়া চলে, চলিতে চলিতে বলে,
আশিটা বছর কেটে গেলো আমি ডাকিনি তোমায় কভু,
আমার ক্ষুধার অন্ন তা বলে বন্ধ করোনি প্রভু।
তব মসজিদ-মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবি,
মোল্লা-পুরুত লাগাইছে তার সকল দুয়ারে চাবি।"

 

আল্লাহর ঘর সবার জন্য উন্মুক্ত থাকার কথা। অথচ আমেরিকাতেও সালাফি, হানাফি, আহলে হাদীস, লা-মাযহাবী—সব আলাদা মসজিদ।
হানাফি মসজিদে সালাফি ঢুকতেই পারে না!
তাই কবি বলেছিলেন—

“খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা,
সব দ্বার এর খোলা রবে, চালাও হাতুড়ি-শাবল চালা।”

 

একজন মানুষ হতে হলে যেমন মানবিক হতে হয়, একজন মুসলমান হতে হলেও ঠিক তেমনই আদর্শ মানুষ হতে হয়।
পরচর্চা, পরনিন্দা, মিথ্যাচার—এসব ইসলামের দৃষ্টিতে সবচেয়ে জঘন্য অপরাধের অন্যতম।

 

নবীজী বলেছেন, যদি তিনজন মানুষ একসাথে থাকে—তবে দু’জন ফিসফিস করে কথা বলবে না, কারণ তৃতীয়জন কষ্ট পেতে পারে।
নবীজীকে এক সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন—“মুসলমানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মুসলমান কে?”
উত্তরে তিনি বললেন:
“যে মানুষের সঙ্গে উত্তম আচরণ করে।”
কারণ মানুষের সঙ্গে উত্তম আচরণ করাই হচ্ছে—আসলে আল্লাহর সঙ্গে উত্তম আচরণ।

নবীজী আরও বলেছেন:

“হাশরের দিন বলবেন খোদা:
হে আদম সন্তান, আমি চেয়েছিলাম ক্ষুধায় অন্ন—তুমি করোনি দান।
মানুষ বলবে: আপনি তো জগতের প্রভু,
আমরা কিভাবে খাওয়াবো আপনাকে?
তিনি বলবেন:
আমার এক বান্দা এসেছিল তোমার দরজায়, ক্ষুধার্ত ছিল সে,
তুমি যদি তাকে খাওয়াতে, তবে আমার সান্নিধ্যও পেতে।”

 

দেখুন, শুধু নামাজ, রোজা, হজ্ব, তেলাওয়াতের জন্য মানুষকে দুনিয়াতে পাঠানো হতো না।
দুনিয়া হলো এক পরীক্ষা কেন্দ্র—এখানে দুশ্চিন্তা আছে, অনিশ্চয়তা আছে, অভাব আছে, রোগ-শোক আছে, লোভ আছে।
এই সবের মধ্য দিয়ে আমাদেরকে পরীক্ষা দিতে হয়—আমরা কতটুকু নৈতিক থাকি, কতটুকু সহনশীল হই, কতটুকু সংযমী হতে পারি।

 

একজন মানুষ যদি শতভাগ ধর্মীয় মূল্যবোধ ধারণ করতে পারেন—আখেরাত বাদ দিলেও—এই দুনিয়াতেই তিনি অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে উঠেন।
এটাই ধর্মের সৌন্দর্য।

(সজল রোশনের বক্তব্য অবলম্বনে)

আরও পড়ুনঃ বিদায় হজ্বের ভাষণ নিয়ে মিথ্যাচার

Post a Comment

Previous Post Next Post