বিদায় হজ্বের ভাষণ নিয়ে মিথ্যাচার


বিদায় হজ্বের ভাষণ: হাদীসের নামে বিভ্রান্তির বড় উদাহরণ

“হাদীসের নামে মুসলমানদের ভুল পথে পরিচালিত করার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো—বিদায় হজ্বের ভাষণকে ঘিরে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিকৃতি।”

বিদায় হজ্বের ভাষণ ছিল ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। লক্ষাধিক সাহাবীর উপস্থিতিতে নবীজী (সা.) যে ভাষণ দিয়েছেন, তা নিয়ে মিথ্যাচার বা বিকৃতি করা সম্ভব নয়—এমনটাই সাধারণ ধারণা। অথচ এই ভাষণকে ঘিরেই বিভিন্ন দল, মত ও উপদল নিজেদের মতবাদ প্রতিষ্ঠায় বহু বিভ্রান্তিকর বক্তব্য প্রচার করে আসছে।

বিশেষ করে শিয়া, সুন্নি বিভাজন, হাদীসকে কোরআনের সমকক্ষ করে শরীয়ার উৎস বানানোর ভিত্তি—এই বিদায় হজ্ব ও গাদিরেখুমের ভাষণের ‘অথরিটি’ নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে।

কোরআনে এই দুটি ভাষণের পূর্ণ বিবরণ নেই। তাই হাদীস বিশ্লেষণের আলোকে আমরা এই ভাষণগুলোর প্রকৃত বার্তা অনুধাবনের চেষ্টা করব।


আরও পড়ুনঃ  হাদীস সংগ্রহ, সংকলন ও সংরক্ষণের ইতিবৃত্ত


কোরআনের স্থান ও হাদীসের প্রাধান্য

ধর্মের নামে যা কিছু প্রচলিত আছে—বিশেষ করে বহু বিধান ও আচরণ—তাতে কোরআনের ভিত্তি পাওয়া না গেলেই উত্তর আসে, "শরীয়তের উৎস হলো কোরআন ও হাদীস।" কিন্তু প্রশ্ন হলো—হাদীস কী পরিমাণ শরীয়তের উৎস? মূলধারার ‘সহীহ বুখারী’ ও ‘সহীহ মুসলিম’কে বলা হয় সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হাদীস গ্রন্থ। এই দুই গ্রন্থের নামের শুরুতেই ‘সহীহ’ যুক্ত থাকার কারণও তাই।

তবে ছিয়াছিত্তা নামে পরিচিত ৬টি হাদীস গ্রন্থের (বুখারী, মুসলিম, তিরমিজী, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ) সব হাদীসই যে সহীহ—তা নয়। অনেক হাসান বা যঈফ হাদীসও তাতে আছে। অথচ এসব গ্রন্থকেই ‘বিশুদ্ধ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা অনেকটা বাজারি প্রচারণার মতো।

এর বাইরে শতাধিক মৌলিক ও সংকলিত হাদীস গ্রন্থ আছে, যেগুলোর উৎস, মান, উদ্দেশ্য ও নির্ভরযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে। আমরা অনেকেই যাচাই না করেই "হাদীসে আছে" শুনে মেনে নিয়েছি।


বিদায় হজ্বের ভাষণের বিকৃতি

প্রচলিত বক্তব্য অনুযায়ী, নবীজী (সা.) বিদায় হজ্বের ভাষণে বলেছিলেন—“আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি; কোরআন ও সুন্নাহ। এ দুটি ধারণ করলে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না।” এই বক্তব্য বহু মুসলমান মুখস্ত জানেন, মাদ্রাসার ছাত্রদের কাছে এটি যেন ‘জাতীয় সংগীতের’ মতো।

ঘরের দেয়াল, দোকানের পোস্টার, হজ্জ্ব গাইড—সবখানেই এমন উদ্ধৃতি দেখা যায়। অথচ বিস্ময়করভাবে এই বক্তব্য ছিয়াছিত্তার কোনো হাদীস গ্রন্থেই নেই—না বুখারী, না মুসলিম, না তিরমিজী বা আবু দাউদে। এমনকি মুসনাদ আহমাদ, দারেমী, বাইহাকী, সহীহ ইবনে হিব্বান—সব গ্রন্থে খোঁজ করলেও পাওয়া যায় না।

এই বক্তব্যটি এসেছে “মুস্তাদরাক আল হাকীম” ও “মুয়াত্তা মালেক” গ্রন্থে। কিন্তু:

  • মুস্তাদরাক হাকীম তুলনামূলক অখ্যাত গ্রন্থ।

  • মুয়াত্তা মালেক-এ বর্ণিত হাদীসটি ‘মুরসাল’। অর্থাৎ বর্ণনাকারী বিদায় হজ্বের সময় জীবিতই ছিলেন না! কেবল শুনেছেন বলে দাবি, কিন্তু যিনি বলেছেন তার নাম বলেননি।

অর্থাৎ, এ ধরনের হাদীসের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। মূলধারার হাদীস গ্রন্থে বিদায় হজ্বের ভাষণ নিয়ে যা পাওয়া যায় তা হলো:


ছিয়াছিত্তার হাদীসে বিদায় হজ্বের প্রকৃত বার্তা

১. সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হজ্ব অধ্যায়, হাদীস নম্বর ২৮২১)
২. সুনানে আবু দাউদ (হজ্ব অধ্যায়, হাদীস নম্বর ১৯০৩)

এই দুটি হাদীসে নবীজী (সা.) বলেন:

“আমি তোমাদের মাঝে এমন এক জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরলে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না, আর তা হলো আল্লাহর কিতাব।”

এরপর তিনি সাহাবীদের সাক্ষ্য নেন এবং তিনবার আকাশের দিকে আঙ্গুল তুলে বলেন:

“হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাকো।”

অর্থাৎ, ছিয়াছিত্তার সহীহ হাদীস অনুসারে বিদায় হজ্বের ভাষণে কেবলমাত্র “আল্লাহর কিতাব” আকড়ে ধরার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।


গাদিরেখুম: শিয়া–সুন্নি বিভেদের মূল?

বিদায় হজ্ব থেকে ফেরার পথে গাদিরেখুম নামক স্থানে নবীজী (সা.) একটি ভাষণ দেন, যেটি শিয়া মুসলিমদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিয়ারা এই ভাষণকে ইমামত তত্ত্বের ভিত্তি বলে মনে করেন। তাতে বলা হয়:

“আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি: কোরআন এবং আমার আহলে বাইত।”

এই ‘আহলে বাইত’ বলতে শিয়ারা বোঝেন: আলী, ফাতেমা, হাসান ও হোসাইন (রা.)। তারা বিশ্বাস করেন, এই ভাষণের মাধ্যমেই নবীজী (সা.) আলী (রা.)-কে তাঁর উত্তরসূরি বা খলিফা ঘোষণা করেছেন।

শিয়া বিশ্বাস অনুযায়ী:

  • আলী (রা.) ছিলেন প্রথম “ওলি” বা “মওলা”

  • কিয়ামত পর্যন্ত ১২ জন ইমাম আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্বাচিত হবেন।

  • এদের অনেককে নবীর সমকক্ষ মনে করা হয়।

এমনকি আযান ও ইকামতে “আলি ওলিউল্লাহ” উচ্চারণ করা হয়, যা সুন্নি চর্চায় অনুপস্থিত।


কোরআন কী বলে?

কোরআন নিজেই নিজেকে বলেছে:

  • “হুদাল্লিল মুত্তাকিন” – মুত্তাকীদের জন্য পথনির্দেশ।

  • “তিবইয়ানাল্লি কুল্লি শাই’” – সব কিছুর বিশদ ব্যাখ্যা।

  • “ফুসসিলাত” – বিস্তারিতরূপে ব্যাখ্যাত গ্রন্থ।

সুরা আহযাব অনুযায়ী “আহলে বাইত” বলতে মূলত নবী পত্নীদের বোঝানো হয়েছে, যাদেরকে উম্মুল মু’মিনীন বলা হয়েছে। এই তথ্য শিয়াদের মতবাদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।


হাদীস শাস্ত্রের নীতিমালা অনুযায়ী

  • কোনো হাদীস কোরআনের বিপরীত হলে তা বাতিল।

  • দুই হাদীস পরস্পর বিরোধী হলে উভয়টিই বাতিল।

  • বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল হলে হাদীস অকার্যকর।

এই ভিত্তিতে “সুন্নাহ” বা “আহলে বাইত” আকড়ে ধরার বক্তব্যবিশিষ্ট হাদীসগুলো গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ তারা কোরআনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।


উপসংহার

বিদায় হজ্বের ভাষণ অনুযায়ী নবীজী (সা.) তাঁর উম্মতের প্রতি একটিমাত্র নির্দেশ দিয়েছেন—আল্লাহর কিতাবকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করা। অথচ ‘দুটি জিনিস’ ধারণ করার হাদীস অখ্যাত, মুরসাল, পরস্পরবিরোধী ও কোরআনের নীতিমালার পরিপন্থী।

এই সত্যটি মানুষের কাছ থেকে গোপন রাখা হয়েছে। যারা সত্য জানতে চায়, তাদের উচিত মূলধারার হাদীস গ্রন্থে ফিরে যাওয়া। বিদায় হজ্বের ভাষণ একটি ঐতিহাসিক সত্য, এটি বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা যেমন অন্যায়, তেমনি তা ছড়িয়ে দেওয়া এক ধরনের ধর্মীয় জালিয়াতি


পুনশ্চ:
“হাদীস সংগ্রহ, সংকলন ও সংরক্ষণের ইতিবৃত্ত” নামে হাদীস সংকলনের জটিল ইতিহাস নিয়ে আমাদের আরেকটি নিবন্ধ পড়ার অনুরোধ রইল। সেখানে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, কিভাবে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসে। 

আল্লাহ আমাদের সত্য উপলব্ধির তৌফিক দিন। আমীন।

আরও পড়ুনঃ  হাদীস সংগ্রহ, সংকলন ও সংরক্ষণের ইতিবৃত্ত


 

Post a Comment

Previous Post Next Post