ইসরায়েলিদের দেশত্যাগ কেন বাড়ছে? নিরাপত্তাহীনতা, রাজনীতি ও ভবিষ্যতের শঙ্কা

 

ছবিঃ প্রতীকী (যমুনা টেলিভিশনের সৌজন্যে)


ভূমিকা

ইসরায়েল বর্তমানে এক অস্থির সময় পার করছে। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাহীনতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্তর্জাতিক সমালোচনা এবং মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ পরিস্থিতি একত্রিত হয়ে অনেক ইসরায়েলিকে বাধ্য করছে দেশ ছাড়তে। এই ‘দ্বিতীয় দফার দেশত্যাগ’—যেটা ১৯৭০–৮০ দশকের সোভিয়েত-ইহুদিদের ইসরায়েল অভিমুখে আগমনের বিপরীত প্রবাহ—আজকের বিশ্বরাজনীতিতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ট্রেন্ড হয়ে উঠেছে।


আরো পড়ুনঃ  ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত ২০২৫

 

নিরাপত্তার প্রশ্নে উদ্বেগ

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলার পর থেকে ইসরায়েলের জনগণের নিরাপত্তাবোধ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হামাস, হিজবুল্লাহ এবং হুতি মিলিয়ে তিনদিক থেকে চলমান যুদ্ধাবস্থা এবং ইরানের সরাসরি হুমকি ইসরায়েলিদের আতঙ্কে রেখেছে।

 

এছাড়া, গাজার যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যাওয়ায় এবং দক্ষিণ লেবাননের সীমান্ত উত্তপ্ত থাকায় বহু সাধারণ নাগরিক—বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকা ও দক্ষিণাঞ্চলের বাসিন্দারা—নিজেদের পরিবারসহ বিদেশে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।


আরও পড়ুনঃ  ট্রাম্পের বিশ্বনীতি ‘যুদ্ধ চাই না’: আসলে বাস্তবতা কী?

 

অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভাজন

ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ন্যায়ের শাসনব্যবস্থা নিয়ে যে সংকট চলছে—বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সরকারের বিচারব্যবস্থা সংস্কারের বিতর্ক ও সর্বগ্রাসী ক্ষমতার চর্চা—তা দেশটির উদারপন্থী, ধর্মনিরপেক্ষ ও বামপন্থী ইহুদিদের মধ্যে গভীর হতাশা সৃষ্টি করেছে।

 

বহু শিক্ষিত, তরুণ এবং হাই-টেক কর্মী এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিজেকে নিরাপদ মনে করছেন না। তারা মনে করেন, ইসরায়েলের গণতন্ত্র হুমকির মুখে এবং ধর্মীয় রক্ষণশীল গোষ্ঠী এখন প্রভাব বিস্তার করছে। ফলে, তারা ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ার দিকে পাড়ি জমাচ্ছেন।


আরও পড়ুনঃ  ইরানে হামলা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি

 

অর্থনৈতিক চাপ ও বিনিয়োগ হ্রাস

গাজা যুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক বয়কট আন্দোলনের (BDS) প্রভাব পড়েছে ইসরায়েলের অর্থনীতিতে। বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠান ইসরায়েলি বাজার থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে, বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে, এবং দেশটির হাই-টেক খাত (যেটি GDP-এর বড় অংশ) সংকটে পড়েছে।

এই পরিস্থিতিতে অনেকে চাকরি হারাচ্ছেন, স্টার্টআপগুলো ধুঁকছে, এবং বহু পেশাজীবী পরিবার নতুন ভবিষ্যতের আশায় পাড়ি জমাচ্ছেন ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকায়।


আরও পড়ুনঃ  খামেনির ক্ষমতা হস্তান্তর

 

আন্তর্জাতিক আইনি চাপ

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত চলছে। আইসিজে ও আইসিসির বিচার প্রক্রিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার অভিযোগ, এবং আন্তর্জাতিক মহলের চোখ রাঙানি অনেক ইসরায়েলিকে উদ্বিগ্ন করেছে—বিশেষ করে যারা সেনাবাহিনীতে দায়িত্ব পালন করেছেন বা সরকারি পদে রয়েছেন।

তাদের মধ্যে কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক ভ্রমণ সীমিত হয়ে পড়বে, কিংবা তারা বিচারের মুখোমুখি হতে পারেন। এ কারণে ‘নিষ্ক্রমণ এখনই নিরাপদ’—এই চিন্তা থেকেই দেশ ছাড়ছেন অনেকে।


আরও পড়ুনঃ  ইরানে মার্কিন হামলা: তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছায়া না কৌশলগত বার্তা?

 

মানসিক চাপ ও যুদ্ধবিরোধী অবস্থান

অনেক ইসরায়েলি—বিশেষ করে মানবাধিকারকর্মী, চিকিৎসক, একাডেমিশিয়ান ও শান্তিকামী নাগরিকরা—বর্তমান যুদ্ধ ও এর ধ্বংসযজ্ঞে মর্মাহত। গাজায় শিশুহত্যা, অবরোধ ও জাতিগত নিধনের অভিযোগে তারা নিজের দেশ সম্পর্কে গভীর হতাশা প্রকাশ করছেন।

 

তাদের অনেকেই বলছেন, "এই ইসরায়েল আমার দেশ নয়", "আমরা এই অপরাধে অংশ নিতে পারি না"—এমন অবস্থান থেকে দেশত্যাগ করছেন।

 

'ডুয়াল সিটিজেনশিপ' ও সহজ অভিবাসন প্রক্রিয়া

ইসরায়েলের অধিকাংশ নাগরিকেরই দ্বিতীয় একটি পাসপোর্ট থাকে—বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। এতে করে তারা যেকোনো সংকটে সহজেই দেশ ছেড়ে যেতে পারেন। অনেকেই বলছেন, "আমরা সাময়িক যাচ্ছি", কিন্তু বাস্তবতা হলো—তাদের অনেকে আর ফিরছেন না।


আরও পড়ুনঃ  পশ্চিমা বিশ্ব কি এক শ্রেণির মুসলমানদের জন্য অনুপযোগী হয়ে উঠছে?

 

উপসংহার

বর্তমান সময়ে ফিলিস্তইনিরা যেখানে ত্রাণের লাইনে দাঁড়িয়েও হত্যার শিকার হচ্ছে, সেখানে ইসরায়েলিদের দলবেঁধে দেশত্যাগ কেবল একটি অভিবাসনপ্রবণতা নয়, বরং একটি রাজনৈতিক ও নৈতিক সংকটের প্রতিফলন। একদিকে নিরাপত্তাহীনতা, অন্যদিকে ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের প্রশ্নে হতাশা ইসরায়েলিদের ‘ভবিষ্যতের ইসরায়েল’ সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।

এই প্রস্থান যদি চলতে থাকে, তাহলে আগামী দশকে ইসরায়েলের সামাজিক কাঠামো, জনসংখ্যাগত ভারসাম্য এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে।

Post a Comment

Previous Post Next Post