ইরানে মার্কিন হামলা: তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছায়া না কৌশলগত বার্তা?


যুক্তরাষ্ট্রের বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমান

 

২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্ব এক নতুন উত্তেজনার মুখোমুখি হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির গোপন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। এই অভিযোগের ভিত্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ইরানি পারমাণবিক স্থাপনায়—নাতাঞ্জ, ইসফাহান এবং ফোরদো—বাঙ্কার-ব্লাস্টার বোমা (GBU-57 A/B) দিয়ে বিমান হামলা চালিয়েছে। একটানা ৩৭ ঘণ্টা উড়ে এই হামলা চালানো হয়েছে বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমান এবং টমাহক ক্ষেপণাস্ত্রের যৌথ ব্যবহারে। হামলার সময় ইরানের জিপিএস ব্যবস্থা জ্যাম করে দেওয়া হয়েছিল বলে মার্কিন সামরিক সূত্রে দাবি করা হয়েছে।

হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক টুইট বার্তায় সরাসরি এ অভিযানের দায় স্বীকার করেন এবং শান্তি আলোচনার প্রস্তাব দেন। অন্যদিকে ইসরায়েল এই অভিযানে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, “বিশ্ব আজ আতঙ্কমুক্ত হয়েছে।” ইসরায়েল একইসাথে জানিয়েছে, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলেও তারা প্রস্তুত।

 

বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমানের উড্ডয়ন সক্ষমতা

বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমান ৫০,০০০ ফুট (১৫,০০০ মিটার) পর্যন্ত উচ্চতায় আক্রমণাত্মক অভিযান পরিচালনা করতে পারে; এর জ্বালানিবিহীন পরিসর ৬,০০০ নটিক্যাল মাইল (১১,০০০ কিমি; ৬,৯০০ মাইল)-এরও বেশি এবং একটি মিডএয়ার রিফুয়েলিং দিয়ে ১০,০০০ নটিক্যাল মাইল (১৯,০০০ কিমি; ১২,০০০ মাইল) এরও বেশি উড়তে পারে। লকহিড এফ-১১৭ নাইটহক আক্রমণ বিমানের পরে এটি ১৯৯৭ সালে উন্নত স্টিলথ প্রযুক্তিতে ডিজাইন করা দ্বিতীয় বিমান হিসেবে পরিষেবাতে প্রবেশ করে। প্রাথমিকভাবে পারমাণবিক বোমারু বিমান হিসেবে ডিজাইন করা, বি-২ প্রথম ১৯৯৯ সালে কসোভো যুদ্ধে প্রচলিত, অ-পারমাণবিক অস্ত্র নিক্ষেপের জন্য যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল। পরে এটি ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, ইয়েমেন এবং ইরানে ব্যবহৃত হয়েছিল।

 

হামলার তাৎপর্য এবং ইরানের প্রতিক্রিয়া

এই হামলাকে ১৯৮০–৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর ইরানের ওপর সবচেয়ে বড় সামরিক আগ্রাসন হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, এটি ইরানের সামরিক সক্ষমতা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করে দিয়েছে। ইরানের পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বড় প্রতিক্রিয়া আসেনি, তবে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটিগুলোর ওপর সম্ভাব্য পাল্টা আঘাতের আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে ৫টি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে এবং সৌদি আরবে অতিরিক্ত ৫০টি যুদ্ধবিমান পাঠিয়েছে। এটা স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্র সম্ভাব্য প্রতিশোধ ঠেকাতে পূর্ণ প্রস্তুতি নিচ্ছে।

 

আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

হামলার পর তুরস্ক, সৌদি আরব বা অন্যান্য মুসলিম প্রধান দেশ ইরানের পক্ষে সরাসরি কোনো অবস্থান নেয়নি। এটি ইরানের কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে—এই পরিস্থিতিতে কি রাশিয়া ও চীন সরাসরি ইরানকে সমর্থন দেবে?

রাশিয়া ও চীনের ভিন্ন ভিন্ন কৌশলগত উদ্বেগ রয়েছে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত, যেখানে ২ জুন ১১৭টি ড্রোন হামলায় রাশিয়ার অন্তত ৪০টি বিমান ধ্বংস হয়েছে বলে দাবি। অন্যদিকে চীন চায়না-তাইওয়ান, জাপান ও ভারতের সাথে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে বাধ্য। এই অবস্থায় চীনের সরাসরি অংশগ্রহণের সম্ভাবনা কম।

 

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা কতটা যৌক্তিক?

এই ঘটনার পরে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও বিশ্লেষক মহলে “তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ” শব্দটি আবার উচ্চারিত হচ্ছে। তবে বাস্তবতা হলো—যুদ্ধের প্রতিধ্বনি যতই শোনা যাক, পরাশক্তিগুলো (বিশেষত রাশিয়া ও চীন) এখনো সরাসরি সংঘাতে জড়াতে নারাজ। বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতি, প্রযুক্তি এবং শক্তি নির্ভরতায় এমন একটি যুদ্ধ পুরো মানবজাতির জন্য আত্মঘাতী হতে পারে।

 

কৌশলগত পর্যালোচনা

বিশ্লেষকদের মতে এই হামলা ছিল বহুদিনের পরিকল্পনার অংশ। এর আগে থেকেই আমেরিকা ডিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপে ছয়টি B-2 বোমারু বিমান মোতায়েন করেছিল। এছাড়াও, পাকিস্তান ও তুরস্কের সঙ্গে নানা গোপন বৈঠক ও আলোচনা হয়েছে। আফগানিস্তানে যেমন আমেরিকা পাকিস্তানের ভূখণ্ড ব্যবহার করেছিল, এবারও একই ধরনের সমন্বয় হয়েছে বলে কিছু সূত্র দাবি করছে।

ইরান যদিও ভূগর্ভস্থ ক্ষেপণাস্ত্র শহর নির্মাণের মাধ্যমে এক প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা নিয়েছিল, কিন্তু তা আমেরিকার B-2 বোমার আঘাতে ধ্বংস হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইসরায়েলও এর আগেই ইরানের কয়েকজন বিজ্ঞানী ও সেনা কমান্ডারকে লক্ষ্যবস্তু করেছিল।

 

উপসংহার

ইরানকে এখন এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কূটনৈতিক আলোচনায় ফিরে না গেলে হয়তো তাদের আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হতে পারে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক পরিসরে বহু নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে—বিশ্ব কি এক নতুন শীতল যুদ্ধের পথে হাঁটছে, নাকি এই কৌশল শুধুই আঞ্চলিক এক সংকেত?

যুদ্ধ নয়, বরং টেকসই শান্তি ও সংলাপই হতে পারে এই সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ। ইরান, আমেরিকা, রাশিয়া এবং চীন—প্রত্যেকের দায়িত্ব বিশ্বকে অনিশ্চিত ধ্বংসের দিকে না ঠেলে, বরং নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার পথে এগিয়ে নেওয়া।



Post a Comment

Previous Post Next Post