২৪ জুলাই পরবর্তী বাংলাদেশের অস্থিরতা: রাশিয়ান দূতাবাসের সতর্কবার্তা ও পশ্চিমা ভূরাজনীতির ছায়া

 

প্রতীকী ছবি

১৫ ডিসেম্বর ২০২৩, রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তার ভাষ্যমতে, ডিসেম্বরে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘটিত সহিংসতা এবং যান চলাচল বন্ধের পেছনে পশ্চিমা কূটনৈতিক তৎপরতার ইন্ধন রয়েছে—বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের ভূমিকা উল্লেখ করা হয়। এই বিবৃতিটি অনেকের নজর এড়িয়ে গেলেও, ২৪ জুলাই ২০২৪-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে তা যেন এক পূর্বাভাস হিসেবে ফিরে আসে। 

রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিসেম্বর ২০২৩-এর বিবৃতি কি ২৪ জুলাই-পরবর্তী বাংলাদেশের অস্থিরতার পূর্বাভাস ছিল? যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ, আরব বসন্তের আশঙ্কা ও ভবিষ্যৎ রাজনীতির বিশ্লেষণ।

আরও পড়ুনঃ-জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান: দায়িত্ব, চরিত্র ও ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ


 পশ্চিমা ভূমিকার ছায়া ও "আরব বসন্তের" আশঙ্কা

রাশিয়ার এই বার্তাটি শুধু কোনো কূটনৈতিক পর্যবেক্ষণ নয়, বরং এক ধরনের ভেতরের আগুনের গন্ধ পাওয়া সতর্কবার্তা। বিবৃতিতে বলা হয়, "যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের ফলাফলে সন্তুষ্ট না হয়, তবে আরব বসন্তের মতো অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টাও হতে পারে।"


২০২৪ সালের জানুয়ারি নির্বাচন এবং ২৪ জুলাইয়ের পর থেকে বাংলাদেশে যে সহিংসতা, গণআন্দোলন এবং রাজনৈতিক স্থবিরতা শুরু হয়, তা অনেকাংশে এই মন্তব্যকে বাস্তব রূপ দিতে শুরু করে। নানা পেশাজীবী গোষ্ঠীর বিক্ষোভ, শিল্প-প্রতিষ্ঠানে অঘোষিত ধর্মঘট, এবং প্রশাসনিক কাঠামোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব—সবকিছু মিলিয়ে যেন একটি পরিকল্পিত অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ- রাশিয়া কেন ইরানকে সাহায্য করছে না?


সার্বভৌমত্ব নাকি ভেতর থেকে বিভাজন?

রাশিয়ার বক্তব্যে স্পষ্টভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে "ওয়াশিংটনের অভদ্র হস্তক্ষেপ" উল্লেখ করা হয়েছে। প্রশ্ন ওঠে, এই হস্তক্ষেপের উদ্দেশ্য কী? নির্বাচনী ফলাফলকে নিজের পছন্দমতো প্রভাবিত করা? নাকি দীর্ঘমেয়াদি ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার?


জুলাইয়ের পর দেখা যায়, দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ফাটল, দায়িত্ব পালনে সেনা ও বেসামরিক কাঠামোর মধ্যে অস্পষ্টতা এবং একটি স্বল্পদৃষ্টিসম্পন্ন অন্তর্বর্তী ক্ষমতা কাঠামো তৈরি হয়েছে। এ যেন এক ‘কনস্টিটিউশনাল ভ্যাকুয়াম’, যার সুযোগে দেশি-বিদেশি শক্তি সক্রিয় হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুনঃ- বাংলাদেশে পাকিস্তানের আইএসএই-এর স্লিপার সেলের উপস্থিতিঃ একটি বিশ্লেষণ


আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভূরাজনৈতিক পুনর্বিন্যাস

২৪ জুলাইয়ের পর জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র যে বিবৃতি দেয়, তা ছিল "গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবাধিকার" প্রসঙ্গে, কিন্তু রাশিয়া তা দেখেছে এক পক্ষের প্রতি অতিমাত্রায় সহানুভূতির প্রমাণ হিসেবে। চীনের নীরবতা ও ভারতের দ্বিধান্বিত অবস্থান এই সময় বাংলাদেশকে আরও এক ভূ-রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে ঠেলে দেয়।


রাশিয়ার মতো রাষ্ট্র যারা ঐতিহ্যগতভাবে ‘অ-হস্তক্ষেপনীতি’র পক্ষে, তাদের এহেন মন্তব্য বুঝিয়ে দেয়—বাংলাদেশ এখন আর শুধু দক্ষিণ এশিয়ার অভ্যন্তরীণ ইস্যু নয়, বরং এক বৃহৎ আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বের লাইন অফ কন্ট্রোল।

আরও পড়ুনঃ- বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র যৌথ সামরিক মহড়া: দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নতুন দিগন্ত


 সামনে কোন পথ?

রাশিয়ার বিবৃতি শেষ হয় এক আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে:

"আমরা নিশ্চিত, সমস্ত বহিরাগত চক্রান্ত সত্ত্বেও, অবশেষে বাংলাদেশের বন্ধুসুলভ জনগণই বাংলাদেশে ক্ষমতার বিষয়টি নির্ধারণ করবে এবং অন্য কেউ নয়।"

কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই নির্ধারণ কী শান্তিপূর্ণ হবে? নাকি আবারও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি?


উপসংহার:

রাশিয়ান দূতাবাসের ডিসেম্বর ২০২৩-এর বিবৃতি এখন আর কেবল ‘কূটনৈতিক ভাষ্য’ নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ ব্যাখ্যার একটি মূল চাবিকাঠি হয়ে উঠেছে। যারা মনে করেছিল আন্তর্জাতিক রাজনীতি বাংলাদেশে শুধুই উন্নয়ন প্রকল্প আর ঋণের হিসাব—তাদের জন্য এই বিবৃতি একটি চমকজাগানিয়া বাস্তবতা।


বাংলাদেশের রাজনীতিতে আগামী দিনগুলো শুধু স্থানীয় শক্তির দ্বন্দ্বে নির্ধারিত হবে না, বরং আন্তর্জাতিক চাপ ও স্বার্থের সমীকরণে সেটি কোন পথে মোড় নেবে, সেটাই এখন মূল প্রশ্ন।

আরও পুড়ুনঃ- জুলাই আন্দোলনের ‘শহীদের’ তালিকায় জালিয়াতি: ভুয়া দাবিদার!


 সূত্র:

  • রাশিয়ান দূতাবাস, ঢাকা: Telegram পোস্ট t.me/rusembbd/9428

  • বিবৃতি তারিখ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩

  • প্রেক্ষাপট: ২৪ জুলাই ২০২৪ পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি



রাশিয়ান দুতাবাসের পোষ্ট




Post a Comment

Previous Post Next Post