বঙ্গবন্ধুর ছবি ছাড়াই নতুন মুদ্রা: একটি বিশ্লেষণ

 



সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ছাড়াই নতুন মুদ্রা বাজারে ছাড়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত সমাজে নানা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে—একদিকে কেউ একে ‘প্রশংসনীয় নিরপেক্ষতা’ হিসেবে দেখছেন, অন্যদিকে কেউ এটিকে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে খাটো করার প্রয়াস হিসেবে বিবেচনা করছেন। এই নিবন্ধে আমরা বিষয়টি রাজনৈতিক, সাংবিধানিক, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করবো।


বঙ্গবন্ধুর ছবি কেন মুদ্রায় ছিল?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর নেতৃত্ব ও ত্যাগ দেশের ইতিহাসে অনন্য। তাই ১৯৯৬ সালের পর বিভিন্ন সরকার তাঁর ছবি মুদ্রা ও ব্যাংকনোটে যুক্ত করে—জাতীয় ঐক্য, ইতিহাসের স্বীকৃতি ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রতীক হিসেবে।


হঠাৎ পরিবর্তনের তাৎপর্য কী?

২০২৫ সালের ঈদ উল আযহার আগে  বাংলাদেশ ব্যাংক বঙ্গবন্ধুর ছবি ছাড়া নতুন ২০, ৫০ ও ১০০০ টাকার নোট ছেড়েছে,যা আজ সোমবার থেকে বাজারে আসার কথা। নতুন নকশার এ তিন নোট ছাড়াও ৫০০, ২০০, ১০০, ১০, ৫ ও ২ টাকা নতুন করে ছাপানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। 

সরকার বলছে, এটি শুধুই "নতুন ডিজাইনের অংশ" এবং পুরনো নোটগুলোও সচল থাকবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে:

  • কেন হঠাৎ এই পরিবর্তন?
  • ডিজাইন পরিবর্তনের যৌক্তিকতা কতটা গ্রহণযোগ্য?
  • এই সিদ্ধান্ত কি শুধুই কারিগরি, নাকি রাজনৈতিক বার্তা বহন করে?


রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি

বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটেছে। দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের বাইরে। তাই কেউ কেউ মনে করছেন, বঙ্গবন্ধুর ছবি বাদ দেওয়া একটি “সাবধানী রাজনৈতিক অবস্থান”—যাতে প্রশাসন নিরপেক্ষতা প্রদর্শন করতে পারে।

তবে সমালোচকরা বলছেন, এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে ছোট করা হচ্ছে, যা এক ধরনের ইতিহাস বিকৃতি। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনাতেই শেখ মুজিবের নাম রয়েছে—তাঁর অবদান ঐতিহাসিক ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়েছে।


সাংবিধানিক ও নীতিগত দৃষ্টিকোণ

বাংলাদেশের সংবিধান বা আইন মুদ্রায় কোন ব্যক্তির ছবি থাকা বাধ্যতামূলক করে না। এটি নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। তবে রাষ্ট্রের প্রতীক ও স্মারক হিসেবে যে-কোনো পরিবর্তন অত্যন্ত সংবেদনশীল। জনগণের মতামত, ঐতিহাসিক সত্য ও মূল্যবোধ বিবেচনা না করে এমন পরিবর্তন সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করতে পারে।


সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

মুদ্রা কেবল আর্থিক বিনিময়ের মাধ্যম নয়; এটি একটি দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ। বঙ্গবন্ধুর ছবি দীর্ঘদিন ধরে দেশের জনগণের মাঝে একটি চেতনার প্রতীক হিসেবে কাজ করেছে। হঠাৎ করে এই চিত্র সরিয়ে দেওয়া মানে শুধুই একটি ছবি অপসারণ নয়—এটি একটি মানসিক অভ্যস্ততা ও ইতিহাসের প্রতীক মুছে দেওয়া।


আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

বিশ্বের অনেক দেশেই প্রতিষ্ঠাতা নেতার ছবি মুদ্রায় ব্যবহৃত হয়—ভারতে মহাত্মা গান্ধী, আমেরিকায় জর্জ ওয়াশিংটন, দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলা। তাই প্রশ্ন থেকে যায়, বাংলাদেশ কেন একটি প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্য থেকে সরে এল?


উপসংহার

বঙ্গবন্ধুর ছবি বাদ দিয়ে নতুন নোট চালু করার সিদ্ধান্ত একটি প্রশাসনিক পদক্ষেপ হলেও এর গভীরে রয়েছে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বার্তা। যদি সরকার সত্যিই নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে চায়, তবে সেটি হওয়া উচিত ব্যাপক জনপরামর্শ, ঐতিহাসিক সচেতনতা এবং সাংবিধানিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে।

এই সিদ্ধান্ত আগামী দিনে কী বার্তা বহন করবে—তা নির্ভর করবে ভবিষ্যতে নেওয়া পদক্ষেপের ওপর। ইতিহাসকে অস্বীকার নয়, বরং উদারতা ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে সম্মান জানানোই একটি গণতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য।

লেখক: আতাউর রহমান খান
তারিখ: ০২ জুন ২০২৫
ব্লগ: bruchlee.com

Post a Comment

Previous Post Next Post