দক্ষিণ এশিয়ায় জঙ্গিবাদ: ইতিহাস, ভূরাজনীতি ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
ছবিঃ সংগৃহীত (প্রতীকী) |
বর্তমান বিশ্বে ছোট-বড় মিলে প্রায় পাঁচ হাজার সক্রিয় চরমপন্থী ও জঙ্গি
সংগঠন সক্রিয় রয়েছে। এদের অনেকে সরাসরি রাজনৈতিক স্বার্থ, বৈদেশিক কৌশল এবং
ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গঠিত বা পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত হয়েছে। এর মধ্যে মুসলিম
ব্রাদারহুড, আল কায়েদা, তালেবান, হামাস, জামায়াতে ইসলামী, রোহিঙ্গা সশস্ত্র
সংগঠনসহ বহু গোষ্ঠী নানা সময়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে
এসেছে।
মুসলিম ব্রাদারহুড: আদর্শিক ভিত্তি ও
প্রভাব: ১৯২৮ সালে মিশরে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম ব্রাদারহুড (ইখওয়ানুল মুসলেমিন)
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ইসলামপন্থী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠন। এর প্রতিষ্ঠাতা
হাসান আল বান্না ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। অনেকে মনে করেন,
মুসলিম ব্রাদারহুড আধুনিক ইসলামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনের রূপরেখা তৈরি করে, যার
আদর্শ পরবর্তীতে হামাস, জামায়াতে ইসলামী, হিজবুল মুজাহেদীনসহ অন্যান্য গোষ্ঠীর
ওপর প্রভাব ফেলেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা ও পরবর্তীতে পশ্চিমা আধিপত্যের
বিরোধিতা থেকে এই সংগঠনের আদর্শিক অবস্থান গঠিত হলেও, তাদের কার্যক্রম বিভিন্ন
সময়ে চরমপন্থী ও সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ আছে। কিছু গবেষক
দাবি করেন, নাৎসি জার্মানির সাথে মুসলিম ব্রাদারহুডের সম্পর্ক ছিল, যদিও এ নিয়ে
ঐতিহাসিকভাবে বিতর্ক রয়েছে।
হামাস, কাতার ও তুরস্কের ভূমিকা: ফিলিস্তিনের
ইসলামপন্থী সংগঠন হামাস ১৯৮৭ সালে গাজা উপত্যকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি মূলত মুসলিম
ব্রাদারহুডের ফিলিস্তিনি শাখা হিসেবে বিবেচিত। বিভিন্ন সময়ে হামাস মধ্যপ্রাচ্যের
কিছু রাষ্ট্র—বিশেষ করে কাতার ও তুরস্ক—থেকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা পেয়েছে
বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১২ সালে কাতারের আমীর শেখ
হামাদ বিন খলিফা হামাসকে অর্থ সহায়তা দেন। তবে এই সহায়তার পেছনে মার্কিন প্রভাব
বা প্রেসক্রিপশনের বিষয়টি বিতর্কিত এবং তথ্যসূত্রের ভিত্তিতে যাচাই করা প্রয়োজন।
জঙ্গিবাদ ও দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি: ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত
ইউনিয়ন আফগানিস্তানে হস্তক্ষেপ করলে যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও সৌদি আরব একযোগে মুজাহেদীনদের
সহায়তা করে। মার্কিন সিআইএ এবং পাকিস্তানের আইএসআই আফগানিস্তানে ইসলামপন্থী
গেরিলা সংগঠনকে সমর্থন দেয়। এই প্রক্রিয়ায় গঠিত হয় আল কায়েদা, যার
প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেন আফগান যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
বাংলাদেশও এই সময়কালে পরোক্ষভাবে এই বৈশ্বিক প্রকল্পে যুক্ত হয়। বিশ্লেষক বার্টিল
লিন্টনার তার লেখায় উল্লেখ করেন, ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সালের মধ্যে অনেক বাংলাদেশি
আফগান যুদ্ধের মুজাহেদীন আন্দোলনে অংশ নেন। তাঁর মতে, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর
রহমান ইসলামী রাজনীতি ও জঙ্গিবাদের প্রতি নরম মনোভাব দেখান, যা বাংলাদেশের
ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয়ের পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে।
সাম্প্রতিক প্যাহেলগাঁও
হামলাঃ ২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার
পহেলগাঁওর বাইসারান উপত্যকায় একটি ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা সংঘটিত হয়। পাঁচজন
সশস্ত্র জঙ্গি পর্যটকদের লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি চালায়, এতে ২৬ জন নিহত হন,
যাদের অধিকাংশই হিন্দু পর্যটক ছিলেন।
হামলাকারীরা পর্যটকদের ধর্মীয় পরিচয় যাচাই করে হিন্দু ও অমুসলিমদের আলাদা
করে হত্যা করে। কিছু পর্যটককে ইসলামি কালিমা পাঠ করতে বলা হয়। যারা পারেননি,
তাদের গুলি করা হয়। একজন স্থানীয় মুসলিম টাট্টু চালক, সৈয়দ আদিল হুসেন শাহ,
পর্যটকদের রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হন।
হামলার দায়িত্ব প্রথমে "দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট" (TRF) নামক
একটি সংগঠন স্বীকার করলেও পরে তা প্রত্যাহার করে। TRF-কে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন
‘লস্কর-ই-তৈয়বা’র একটি শাখা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
![]() |
ছবিঃ সংগৃহীত |
এই হামলার পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ভারত
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে মদদ দেওয়ার অভিযোগ এনে ইন্দাস ওয়াটারস চুক্তি
স্থগিত করে, পাকিস্তানি কূটনীতিকদের বহিষ্কার করে এবং সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। পাকিস্তান
পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে সিমলা চুক্তি স্থগিত করে, বাণিজ্য সীমিত করে এবং আকাশসীমা
বন্ধ করে দেয় ।
ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী কাশ্মীর অঞ্চলে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে, যার ফলে
২,০০০-এর বেশি মানুষ আটক হন এবং সন্দেহভাজন জঙ্গিদের পরিবারের বাড়িঘর ভেঙে ফেলা হয়।
এই পদক্ষেপগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের মুখে পড়ে।
এই ঘটনার ফলে কাশ্মীরের পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে এবং ভারত-পাকিস্তান
সম্পর্ক আরও সংকটপূর্ণ হয়েছে।
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান: বাংলাদেশে খতমে
নবুয়ত আন্দোলন, জেএমবি, হরকাতুল জেহাদ, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আইএস সমর্থিত
গোষ্ঠীসহ প্রায় ৪০টির মতো চরমপন্থী সংগঠন সক্রিয় রয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর
তথ্য। হোলি আর্টিজান হামলা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী সিরিজ
বোমা হামলাসহ বিভিন্ন ঘটনায় এসব গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এদের অনেকেই আদর্শিকভাবে মুসলিম ব্রাদারহুড বা জামায়াতে
ইসলামীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। জামায়াতে ইসলামী, যার সূচনা উপমহাদেশে মওদুদীর হাত ধরে,
পাকিস্তানে জঙ্গি সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতায় যুক্ত থাকার অভিযোগ অনেক আগে থেকেই রয়েছে।
রোহিঙ্গা সশস্ত্র সংগঠন ও আঞ্চলিক
জটিলতা: ১৯৮০-এর দশকে রোহিঙ্গা প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট ভেঙে গঠিত হয় রোহিঙ্গা
সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (RSO), যার কার্যক্রমে চরমপন্থী রূপ দেখা যায়। এটি
আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কিছু চরমপন্থী সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে
বার্টিল লিন্টনার উল্লেখ করেন। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভেতর থেকেও
বিভিন্ন সময়ে উগ্রপন্থী তৎপরতার আলামত পাওয়া গেছে।
ভবিষ্যৎ শঙ্কা ও রাষ্ট্রের করণীয়: বাংলাদেশ একটি
ঘনবসতিপূর্ণ, অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ায় এখানে ধর্মীয় উগ্রপন্থার
বিস্তার ঠেকাতে রাষ্ট্রকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে। উন্নয়ন, শিক্ষা, সামাজিক
সংহতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে ধর্মীয় চরমপন্থা সহজেই জমি পাবে।
তবে বাংলাদেশের জনগণ অতীতে বারবার চরমপন্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে।
এজন্য রাষ্ট্র, সুশীল সমাজ এবং নাগরিকদের যৌথভাবে কাজ করে যেতে হবে যেন দেশটি কখনো
জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত না হয়।
জঙ্গিবাদ একটি আঞ্চলিক বা ধর্মীয় সমস্যা নয়—এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যা
রাজনৈতিক স্বার্থে অনেক সময় ব্যবহার হয়। অতীত ইতিহাস জানলেও ভবিষ্যতের জন্য
গুরুত্বপূর্ণ হল সচেতনতা, শিক্ষা, সমালোচনাশীল দৃষ্টিভঙ্গি ও শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র
গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন।