ইজিকিয়েল কি নবী ছিলেন?

 

কল্পচিত্র সংগ্রহ ইন্টারনেট থেকে

ইজিকিয়েল ছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর একজন নবী, যিনি ব্যাবিলের বন্দিদশা থেকে ঈশ্বরের বার্তা প্রদান করেছিলেন। তাঁর দর্শন, ভবিষ্যদ্বাণী নতুন মন্দিরের প্রতিশ্রুতি আজও বিশ্বাসীদের অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু একথা আমরা ক’জনাই জানি। তাই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক – ইজিকিয়েল কি আসলেই নবী ছিলেন?


মূল প্রবন্ধঃ

ইজিকিয়েল: নির্বাসনের যুগে আশা ও পুনর্জাগরণের বার্তাবাহক

পরিচয়
ইজিকিয়েল (Ezekiel) ছিলেন ইহুদি ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নবী ও দ্রষ্টা- যিনি খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে বাবিলীয় বন্দিদশার সময়ে ইসরায়েলিদের মধ্যে ঈশ্বরের বাণী প্রচার করেন। তাঁর নামের অর্থ “ঈশ্বর শক্তি দেন” (God strengthens)। তিনি বাইবেলের পুরাতন নিয়ম (Old Testament)-এর Book of Ezekiel-এর মূল চরিত্র ও লেখক হিসেবে পরিচিত।

 

জীবনী ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

ইজিকিয়েল ছিলেন যাজক পরিবারে জন্ম নেওয়া একজন ইহুদি। বাইবেলের ধারণা থেকে অনুমান করা যায় তাঁর জন্ম খ্রিস্টপূর্ব প্রায় 623 সালের দিকে। তিনি জেরুজালেমে বেড়ে উঠেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব 597 সালে, বাবিল সম্রাট নেবুখাদনেজার জেরুজালেম দখল করার পর অনেক ইসরায়েলিকে নির্বাসনে নিয়ে যান, যাদের মধ্যে ইজিকিয়েলও ছিলেন। নির্বাসিত অবস্থায় তিনি নবী হিসেবে কার্যক্রম শুরু করেন।

 

ইজিকিয়েলের বার্তা ও ভবিষ্যদ্বাণী

ইজিকিয়েলের বাণীকে সাধারণত তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়—

  1. বিচারের ঘোষণা – ইসরায়েল ও যিহূদার অন্যায়, মূর্তিপূজা, সামাজিক অবিচার ও ঈশ্বর থেকে বিচ্যুতির কারণে আসন্ন শাস্তির কথা ঘোষণা।
  2. বিদেশি জাতিদের বিরুদ্ধে ভবিষ্যদ্বাণী – মিশর, আম্মোন, মোয়াব, এদোম, ফিলিস্তিয়া, টায়ার প্রভৃতি জাতির ওপর ঈশ্বরের বিচার ঘোষণা।
  3. পুনর্গঠনের আশা – জেরুজালেম ধ্বংসের পর ইসরায়েলের পুনর্জাগরণ ও ঈশ্বরের সঙ্গে নতুন চুক্তির প্রতিশ্রুতি।


প্রসিদ্ধ দর্শন ও প্রতীক

ইজিকিয়েল তাঁর জীবন্ত ও নাটকীয় দর্শনের জন্য পরিচিত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—

  • রথ ও চার জীবন্ত প্রাণীর দর্শন (Ezekiel 1) — ঈশ্বরের মহিমা ও শক্তির প্রতীক।
  • শুষ্ক অস্থির উপত্যকা (Ezekiel 37) — ইসরায়েলের পুনর্জাগরণের প্রতীকী দর্শন।
  • প্রহরীর দায়িত্ব — নবীর ভূমিকা জনগণকে সতর্ক করা, নৈতিক দায়িত্বের স্মরণ করিয়ে দেওয়া।
  • নতুন মন্দিরের দর্শন — ঈশ্বরের উপস্থিতি ও শুদ্ধ উপাসনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।

 

গ্রন্থ ও গঠন

Book of Ezekiel মোট ৪৮ অধ্যায়ে বিভক্ত। এটি হিব্রু বাইবেল ও খ্রিস্টান পুরাতন নিয়মে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা ও চিত্রকল্প সমৃদ্ধ এই গ্রন্থে কবিতা, উপমা, রূপক ও প্রতীকী নাট্যরূপ মিলিত হয়েছে।

 

ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রভাব

  • ইহুদিবাদে – বাবিলীয় নির্বাসনের সময়ে জাতিগত পরিচয় ও ধর্মীয় অনুশাসন ধরে রাখতে ইজিকিয়েলের বাণী অনুপ্রেরণা দেয়।
  • খ্রিস্টধর্মে – নতুন নিয়মের লেখকরা তাঁর দর্শনকে মেসিয়াহর আগমনের ইঙ্গিত হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।
  • ইসলামে – কুরআনে ইজিকিয়েলের নাম উল্লেখ নেই, তবে ইসলামি ঐতিহ্যে তাঁকে সাধারণত হযরত হিযকীল (আঃ) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যিনি এক মৃত জনগোষ্ঠীকে আল্লাহর ইচ্ছায় পুনর্জীবিত করেছিলেন বলে বর্ণিত।
  • শিল্প-সাহিত্যে — মাইকেলএঞ্জেলো থেকে শুরু করে আধুনিক লেখকরা ইজিকিয়েলের চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন।

 

ঐতিহাসিক ও আধুনিক গুরুত্ব

ইজিকিয়েলের জীবন ও বাণী আজও ন্যায়, অনুশোচনা, পুনর্জন্ম ও আশা বিষয়ে মানুষের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। তাঁর দর্শন শুধুমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাসে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সাহিত্য, শিল্পকলা ও দর্শনচিন্তাতেও বিশেষ স্থান দখল করেছে। ইজিকিয়েলের বার্তা আজও কয়েকভাবে প্রাসঙ্গিক—

  1. ন্যায়বিচার — শাসক ও জনগণ উভয়ের জন্য নৈতিক দায়িত্ব পালন অপরিহার্য।
  2. পুনর্জন্মের আশা — সমাজ যত ভগ্নই হোক, পুনর্গঠন সম্ভব।
  3. সতর্কবার্তা — অন্যায় করলে তার পরিণতি ভোগ করতেই হবে।
  4. আধ্যাত্মিক শক্তি — ব্যক্তিগত ও জাতিগত জীবনে ঈশ্বরের প্রতি আস্থা সংকটকালেও টিকে থাকতে সাহায্য করে।

 

উপসংহার
ইজিকিয়েল ছিলেন এমন এক নবী, যিনি বিপর্যস্ত ও নির্বাসিত জাতির মাঝে ঈশ্বরের ন্যায়বিচার ও করুণা—দুইয়ের বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন। তাঁর বাণী ও দর্শন যুগ যুগ ধরে বিশ্বাসীদের মধ্যে আত্মিক শক্তি জুগিয়েছে এবং আজও বিশ্বজুড়ে ধর্মতত্ত্ব ও সংস্কৃতির আলোচনায় সমান প্রাসঙ্গিক। তাঁর জীবন ও বার্তা আজও শেখায়, ন্যায়বিচার ও আধ্যাত্মিক সততার ভিত্তিতেই একটি জাতি টিকে থাকতে পারে।


Post a Comment

Previous Post Next Post