![]() |
ছিত্রঃ ইন্টারনেট থেকে |
‘কথিত’ স্বৈরাচার এরশাদ তখন সেনাপ্রধান থেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক,
তারপর দেশের সকল দন্ডমূন্ডের 'মালিক'। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতির সরকারে তিনিই
সরকার ও রাষ্ট্র প্রধান। ওই সময়ে ১৯৮৮
সালে চিত্রশিল্পী পটুয়া কামরুল হাসান তাঁর ব্যঙ্গচিত্রে তৎকালীন স্বৈরশাসক হুসেইন
মুহাম্মদ এরশাদকে তীব্র বিদ্রূপের মাধ্যমে চিত্রিত করেছিলেন, যার শিরোনাম ছিল— “দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে”। এই একটি চিত্র দেশের মুক্তিকামী মানুষকে
আন্দোলিত করেছিল, সাহস জুগিয়েছিল, এবং শাসকের ক্ষমতার নৈতিক ভিত্তিকে কাঁপিয়ে
দিয়েছিল। এরশাদ টু শব্দটিও করেননি তার বিরূদ্ধে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শিল্প ও সাহিত্যের শক্তি বহুবার সত্য
উচ্চারণের অস্ত্র হয়ে উঠেছে। বর্তমানে দেশ এক মহা সংকটকাল অতিক্রম করছে। বিদেশি ইউটিউব
চ্যানেলের টকশোতে কেউ কেউ মন্তব্য করছেন, ‘এক আন্তর্জাতিক দুর্বৃত্বের কবলে বাংলাদেশ’।
দেশে বসে কি কেউ তার সামান্যতম প্রতিবাদ করতে পারছেন? আজ যদি পটুয়া কামরুল হাসান বেঁচে
থাকতেন এবং ডঃ মোহাম্মদ ইউনুসের ব্যাঙ্গচিত্র এঁকে ক্যাপশন দিতেন “দেশ আজ
আন্তর্জাতিক দুর্বৃত্বের খপ্পরে”- তাহলে কি নিরাপদ থাকতে পারতেন?
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরে ইতিহাস যেন অন্য রূপে পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে।
এবার কোনো একনায়কের নয়, বরং এমন এক সময়ে, যখন ডঃ
মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে অনেকেই পরিবর্তনের
বার্তাবাহক ভেবেছিলেন।— তখন মানুষের সকল আশা ধুলিস্যাৎ করে সমালোচনার কণ্ঠস্বর
ক্রমশ স্তব্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। রাস্ট্রের
সমালোচনার মূল্য আজ জেল
বাংলাদেশে এখন এমন এক পরিবেশ বিরাজ করছে যেখানে সরকারের সমালোচনা
করলেই মামলা, গ্রেফতার, কারাবাস এমনকি মৃত্যু ঝুঁকি মাথায় নিয়ে কথা বলতে হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন তোলার জন্য কিংবা জনসম্মুখে ভিন্নমত প্রকাশ করলেই
সমালোচকদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থার নামে অন্যায়ভাবে নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা
নেয়া হচ্ছে।
যে সরকার জনগণের কাছে জবাবদিহি করার কথা, সেটি যেন প্রশ্ন এড়াতে দমন-পীড়নের পথ
বেছে নিয়েছে।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অবস্থা
বর্তমানে দেশের গণমাধ্যম এমন এক সংকটে পড়েছে, যা ৮০–র দশকের
সেনাশাসনের চেয়েও কঠিন। সংবাদকর্মীরা জানেন— সরকারের বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনামূলক
প্রতিবেদন ছাপা মানে ঝুঁকি নেওয়া। সম্পাদকদের ওপর অদৃশ্য চাপ, সাংবাদিকদের ওপর
মামলা ও হয়রানি এবং সংবাদমাধ্যমের মালিকদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপে বশীভূত
রাখা— সব মিলিয়ে সত্য প্রকাশের স্বাধীনতা আজ গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলিও বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে
ধারাবাহিক পতনের কথা জানাচ্ছে।
জিয়া এরশাদের সামরিক আমল বনাম বর্তমান প্রেক্ষাপট
জিয়া, এরশাদের আমলে সেনাশাসনের কঠরতা ছিল সরাসরি ও প্রকাশ্যে।
রাজনৈতিক বিরোধী দল, ছাত্র আন্দোলন, সাংবাদিক— সবাই ছিলেন তার দমননীতির টার্গেটে।
তখন সাংস্কৃতিক কর্মী, সাংবাদিক কর্মীর এভাবে কন্ঠরোধ করা হয়নি। তখন কামরুল
হাসানের ব্যঙ্গচিত্র এবং এরূপ কর্মকান্ড ছিল জনগণের নীরব প্রতিবাদকে দৃশ্যমান করে
তোলার এক সাহসী মাধ্যম।
বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে হলেও, গণতান্ত্রিক কাঠামোর আড়ালে একই রকম
শ্বাসরোধী বাতাবরণ তৈরি হয়েছে।
তবে পার্থক্য হলো— আজ দমনপীড়নের হাতিয়ার শুধু পুলিশ বা সেনাবাহিনী দিয়ে নয়, বরং
সাইবার আইন, তথ্যপ্রযুক্তি আইন, এবং নানা রকম প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার সাহায্যেই বেআইনী
নির্যাতন চালানো হচ্ছে।
স্বাধীনতার ৫৪ বছরে শিক্ষা কী?
বাংলাদেশ যে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, তার
অন্যতম লক্ষ্য ছিল মানুষের স্ব স্ব ধর্ম পালন তথা মত প্রকাশের স্বাধীনতা। অথচ আজ সেই স্বাধীনতা বারবার প্রশ্নের মুখে
পড়ছে— শাসক যেই হোক না কেন।
স্বাধীন গণমাধ্যম, মুক্ত চিন্তা ও গঠনমূলক সমালোচনা ছাড়া কোনো
সরকারই দীর্ঘমেয়াদে জনগণের আস্থা ধরে রাখতে পারে না। ইতিহাস প্রমাণ করেছে—
মতপ্রকাশ রুদ্ধ করার পথ শেষ পর্যন্ত শাসকের জন্যই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে- তা তিনি
যতোবড় ক্ষমতাধরই হোন না কেনো। এমন নজির এদেশে অসংখ্য।
উপসংহার
আজকের বাস্তবতায় কামরুল হাসানের ব্যঙ্গচিত্রের সেই শিরোনাম— “দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে”— যেন নতুনভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। মানুষের মনে
মনে এই ক্ষোভ জমছে। যদি স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও সংবাদপত্রের মুক্ত পরিবেশ
ফিরিয়ে না আনা যায়, তবে এই ক্ষোভ একদিন বিস্ফোরকে রূপ নেবে— যেমনটি ঘটেছিল এরশাদের পতনের সময়।
Post a Comment