বেসামরিক প্রশাসনে লঙ্কাকাণ্ডঃ আলি শরিয়তির পর্যবেক্ষণ-সাব্বির খান



অবসরপ্রাপ্ত পাঁচজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রথমে সচিব পদে প্রমোশন দিয়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। এর একদিনের মাথায় সবাইকে সিনিয়র সচিব পদমর্যাদা দেওয়া হয়। বেসামরিক প্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের রেওয়াজ বহু পুরানো। কিন্তু অবসরের ৮/১০ বছর পরে বয়োবৃদ্ধদের দুই দফা প্রমোশন দিয়ে প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে বসানোর নজির তেমন নেই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে পা#কিবাহিনীর দোসর শফিউল আজম সিএসপিকে বিদেশ থেকে ধরে এনে ক্যাবিনেট সচিব বানানো হয়েছিল। তখন এমজি তাওয়াবকেও এভাবে বিদেশ থেকে ধরে এনে বিমানবাহিনীর প্রধান বানানো হয়েছিল। মোশতাক-জিয়ার আমলেই এধরনের কিছু বে-নজির সৃষ্টি হয়েছিল। এরপরে আর বাংলাদেশে এরকম ঘটনার নজির নেই। পূর্বে বঞ্চিত বিবেচনায় সর্বোচ্চ কাউকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির নজির আছে। এমনকি ব্যাংক-বীমা ইত্যাদি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত করার নজির থাকলেও তাকে একই সার্ভিসের পদে আসীন করার নজির নেই। কিন্তু এসব নজিরবিহীন ঘটনাই ঘটিয়েছে ইউনূস সরকার।

এর পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, শিল্প মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, পিএসসি, ইলেকশন কমিশন ইত্যাদি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সহ নানান প্রতিষ্ঠানে অনেককে বসিয়েছেন। ইচ্ছামতো কমিটি বানিয়ে, সেই কমিটি দিয়ে তদন্ত করিয়ে অবসরে যাওয়া অগণিত অফিসারকে ভুয়া মূল্যায়নে বঞ্চিত দেখিয়ে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রের বাড়তি অঢেল টাকা খরচ হচ্ছে।
প্রথম দফায় নজিরবিহীনভাবে নিয়োগ পাওয়া পাঁচ সিনিয়র সচিব হলেন ড. শেখ আব্দুর রশিদ, ড. মোহাম্মদ আব্দুল মোমেন, মো. এহছানুল হক, নাসিমুল গনি, এম এ আকমল হোসেন আজাদ।
এই ৫ জনই শেষ নয়। এরপরে একই প্রক্রিয়ায় ক্রমান্বয়ে সিনিয়র সচিব পদে নিয়োগ দেয়া হয়, যথাক্রমে- মোঃ সিরাজ উদ্দিন মিয়া, ড. মোঃ মোখলেস উর রহমান, ড. এম মাহফুজুল হক, মমতাজ আহমেদ, মোহাম্মদ ইউসুফ, এ জে এম সালাহউদ্দিন নাগরী, মো. নিয়ামত উল্লাহ ভুঁইয়া, সিদ্দিক জোবায়ের, এ এস এম সালেহ আহমেদ, আখতার আহমেদ, শীষ হায়দার চৌধুরী, ড. কাইয়ুম আরা বেগম প্রমুখকে।
ইতোমধ্যে অনেকের মন্ত্রণালয় পরিবর্তন হয়েছে। এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলেন ক্যাবিনেট সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব মোঃ সিরাজ উদ্দিন মিয়া, ⁠জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোঃ মোখলেস উর রহমান এবং ⁠স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি।
এই চারজনই অবসরে ছিলেন। ইউনূস সরকার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ও দ্রুত প্রমোশন দিয়ে বড় বড় পদে বসিয়ে বেসামরিক প্রশাসনকে কব্জা করেছে। তারা ইউনূস সরকার ও এনসিপি পার্টির প্রতি ভীষণ অনুগত। নুন খেলে গুণ গাওয়া বাঙালির স্বভাব, এখানে নীতি নৈতিকতা তুচ্ছ।
এই চারজন ছাড়াও আরও অনেককে একই প্রক্রিয়ায় সিনিয়র সচিব/ সচিব পদে বসিয়েছে সরকার। আবার চাকরিত নিয়মিতদের মধ্যে থেকে জামায়াতি ঘরানার অফিসার খুঁজে খুঁজে দ্রুত প্রমোশন দিয়েও সচিব পদে বসানো হয়েছে। কিন্তু এই চারজনের পদ ও দায়িত্ব অনেক বেশি ও গুরুত্বপূর্ণ। এরাই বর্তমানে বেসামরিক প্রশাসনের নিয়ন্ত্রক।
নিয়মানুযায়ী জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে পোস্টিং হবার পরে প্রত্যেক ডিসি যোগদানের আগে তিনজন সচিবের সাথে দেখা করেন এবং ব্রিফ নিয়ে যান। এই তিনজন হলেন ক্যাবিনেট সচিব, জনপ্রশাসন সচিব ও স্বরাষ্ট্র সচিব। বাংলাদেশের বাস্তবতায় ডিসি হলেন একটি জেলার বাপ-মা, অনেকটা পাশের দেশের মুখ্যমন্ত্রীদের মতো।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের নিয়মিত নজির ছিল যে, অবসরের সময় হবার আগেই প্রয়োজন ও গুরুত্ব বিবেচনা করে কাউকে কাউকে প্রশাসন ও দেশের স্বার্থে চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধি করা হতো। এক্ষেত্রে কিছু সুবিধাবাদীও যে অহেতুক সুবিধা নেয়নি বাঁ পায়নি তা নয়। কিন্তু সেটা নগণ্য। কিন্তু অবসরের ১০ বছর পরে এনে ডাবল ট্রিপল প্রমোশন দিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া কেবল ইউনূস সরকারের পক্ষেই সম্ভব। কোন রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে এটা অসম্ভব।
দুটি উদাহরণ দেই -
ক.
অখণ্ড পাকিস্তানের সর্বশেষ ব্যাচের সিএসপি অফিসার ছিলেন আহমদ মাহমুদুর রাজা চৌধুরী। সাবেক মন্ত্রী এম এ মান্নান এবং বর্তমান উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ একই ব্যাচের সিএসপি। আহমদ মাহমুদুর রাজা চৌধুরী হাছন রাজার বংশের কৃতিপুরুষ। কোন দলের রাজনীতির প্রতি ন্যূনতম আনুগত্য নেই। কিন্তু ১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ভদ্রলোককে পিএস পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। একজন অফিসারের দক্ষতা, সততা ও দারুণ প্রশাসনিক-সাংগঠনিক ক্যাপাসিটির কারণে এই নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। তখন তিনি ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার, অর্থাৎ অতিরিক্ত সচিব। কিছুদিনের মধ্যেই ভারপ্রাপ্ত সচিব হবেন। তখন সচিব বানানোর পূর্বে ভারপ্রাপ্ত সচিব বানানোর রেওয়াজ ছিল। যাইহোক, পিএস নিয়োগে এই অফিসারের কোন হাত ছিল না। অফিশিয়াল অর্ডার, তাই মেনে নিয়েছেন এবং যোগদান করেছেন। বেচারা পিএস হিসেবে কাজ করেছেন। কিন্তু ২০০১ সালের ১লা অক্টোবরের পরে তাকে প্রমোশন দূরের কথা, উলটা বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছিল জামায়াত-বিএনপি জোট সরকার। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে, কত সাবেক আমলা কতকিছু চেয়েছেন এবং হয়েছেন। কিন্তু আহমদ মাহমুদুর রাজা চৌধুরী একবারও প্রধানমন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ বা দেখা-সাক্ষাৎ করেননি। শুনেছি, তাকে প্রস্তাব দেয়া হলেও তিনি কিছু হতে আপত্তি জানিয়েছেন। অথচ এই ভদ্রলোককে জোর করে হলেও কোথাও বসানো উচিত ছিল, কারণ এতে দেশ উপকৃত হতো।
খ.
দ্বিতীয় উদাহরণ হলো বদিউর রহমান। ১৯৭৯ ব্যাচের বিসিএস অ্যাডমিন ক্যাডারের অফিসার। ভদ্রলোক তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান হিসেবেই বেশি পরিচিত। বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখেন। সুপার অনেস্ট ও ঘাড় ত্যাড়া অফিসার হিসেবে পরিচিত। ২০০৬ সালের অক্টোবরে তিনি বিদ্যুৎ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব এবং কিছুদিনের মধ্যেই পরিকল্পনা বিভাগের সচিব হয়েছিলেন। ১/১১ সরকারের আমলে এনবিআরের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছিলেন।
‘ডোমুরুয়া থেকে সচিবালয়’ নামক আত্মজীবনীতে লিখেছেন, একজন বিতর্কিত কাস্টম কর্মচারী এবং তৎকালীন চট্টগ্রাম বন্দরের যুগ্ম কমিশনার মতিউর রহমানকে চট্টগ্রাম থেকে রাজশাহীতে নিয়মিত বদলির প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ হাসান নাসির, মেজর জেনারেল সিনা ইবনে জামালী এবং সর্বশেষ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মঈন উ আহমেদ এই বদলি ঠেকাতে তদবির করেছিলেন। কিন্তু বদিউর রহমান কারও কথা শোনেননি এবং সকলের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এরপরেই তাঁর কপালে দুর্যোগ নেমে আসে, অর্থাৎ তাকে এনবিআর থেকে সরিয়ে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব করা হয় এবং সেই মতিউর রহমানকে আবার চট্টগ্রাম বন্দরে বদলি করা হয়। তিনি বাংলাদেশ বিষয়ে আইএমএফ এর নীতি প্রস্তাবের সাথেও দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। এহেন পরিস্থিতিতে তাকে ওএসডি ও এক মাসের ছুটিতে পাঠানো হলে ভদ্রলোক চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। মজার ব্যাপার হলো, সেই বিতর্কিত মতিউর রহমানই হলেন এখনকার ছাগকাণ্ডে আলোচিত ও বিতর্কিত মতিউর রহমান। আর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান নাসির হলেন এখনকার বিখ্যাত টকশোর আলোচক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, মানবাধিকার কর্মী, বিশিষ্ট নীতিবাগিশ এবং বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য ইত্যাদি।
তো আমাদের দেশেই আহমদ মাহমুদুর রাজা এবং বদিউর রহমানের মতো চৌকশ ও ব্যক্তিত্ববান অফিসারও আছেন। যারা পরবর্তীতে কোন সুবিধার আশেপাশে যাননি। আরও অগণিত অফিসার আছেন, যারা বিগত ১৬ বছরে সচিব হতে পারেননি, কিন্তু ইউনূস সরকারের কাছে আবেদনও করেননি প্রমোশন ও আর্থিক সুবিধার জন্য।
অথচ সেই সুবিধা দেবার মতো অনৈতিক কাজই করেছেন ইউনূস সরকার অ্যান্ড গং। এতে অসংখ্য নিয়মিত অফিসারকে ফোর্স রিটায়ারমেন্টে পাঠানো হয়েছে, ওএসডি করা হয়েছে। যারা নিয়মিত প্রক্রিয়ায় সচিব হতেন, তাদের পদোন্নতি ও সচিব হবার পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যা বেসামরিক প্রশাসনের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। আজকেই দেখা গেলো এইসব অনাচারের বিরুদ্ধে সচিবালয় ফুঁসে উঠেছে। অচিরেই হয়ত কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ হতে হতে অবশেষে বিক্ষোভ, প্রতিবাদ ও দাবি আদায়ে মুখরিত হবে আবদুল গনি রোডের ইডেন বিল্ডিং। কেননা, বৈষম্য থেকে মুক্তি পেতে অধিকার আদায়ে সোচ্চার হওয়া অনিবার্য।
রাত পোহাবার কত দেরি, পাঞ্জেরি?

Post a Comment

Previous Post Next Post