প্রতীকী ছবি |
বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তনের প্রশ্নে আদালতের রায় এখনো কার্যকর হয়নি কেন? অন্তর্বর্তী সরকারের বাস্তবতায় বিএনপির রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির সমীকরণ ও আদালতের নীরব অবস্থানের বিশ্লেষণ।
ভূমিকা
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা এক সময় ছিলো নিরপেক্ষ নির্বাচনের অনিবার্য কাঠামো। তবে ২০১১ সালে ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে এই ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এরপর থেকে প্রতি জাতীয় নির্বাচনের আগে এ ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তনের দাবি উঠে এসেছে, বিশেষত প্রধান বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আদালতে এ সংক্রান্ত কিছু মামলা হয়েছে এবং একটি মামলার রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত আইন পুনর্বহালের প্রশ্নে আদালতের নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেনো সেই নির্দেশ এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি? কেনো তা ‘হিমাগারে’ পড়ে আছে?
তত্ত্বাবধায়ক সরকার: সংক্ষিপ্ত পটভূমি
১৯৯৬ সালে গণআন্দোলনের ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংযোজন করা হয়। লক্ষ্য ছিলো, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন আয়োজন। এই কাঠামোয় একজন নিরপেক্ষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হতেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। এই ব্যবস্থায় ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার একে ‘অগণতান্ত্রিক’ আখ্যা দিয়ে বাতিল করে।
আদালতের নির্দেশ ‘হিমাগারে’ কেনো?
১. বিচারপতি নিয়োগ ও নিরপেক্ষতা প্রশ্ন
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি। বর্তমানে বা ভবিষ্যতে যিনি এই পদে দায়িত্ব পেতে পারেন, তিনি যদি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তবে তাঁর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে—এই আশঙ্কা বিএনপির। ফলে বিএনপির রাজনৈতিক লাভ হবে না, এমন একজনের অধীনে নির্বাচনে যেতে তারা আগ্রহী নয়।
২. আদালতের রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা
বাংলাদেশের আদালত বরাবরই রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার প্রয়াসে কিছু সংবেদনশীল সিদ্ধান্তকে 'অকার্যকর' করে রাখে। যদিও আদালত স্বাধীন, বাস্তবতা হলো—কৌশলগত কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রায় দীর্ঘ সময় ধরে কার্যকর হয় না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত নির্দেশনাও সে ধরনের একটি।
রাজনৈতিক সুবিধা-অসুবিধার হিসাব
বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করে আসছে। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরলে সেই কাঠামোর প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে এমন একজন আসতে পারেন, যিনি ‘আওয়ামীলীগ' ঘনিষ্ঠ। এক্ষেত্রে বিএনপি নিজেদের রাজনৈতিক লাভ আদৌ হবে কিনা তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত। যদিও আওয়ামী লীগ এখন অদৃশ্য, তবুও তাদের সেই ভয় থেকেই যায় যে যদি আন্তর্জাতিক চাপে আওয়ামীলীগ নির্বাচনে অংশ নেয়! তাছাড়া বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেরও এ নিয়ে মাথা ব্যাথা নাই, কারণ যদি নির্বচন হয় তাহলে তাদের অধীনেই হবে এবং তাদের সমর্থক দল ক্ষমতায় আসবে- এটাই তাদের কৌশল হয়তো। তাই উভয় পক্ষই এই ইস্যুতে একপ্রকার অচলাবস্থায় রয়েছে—এবং আদালতের নির্দেশও সেই অচলাবস্থার বলি হয়েছে।
উপসংহার
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা বলছে—তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুটি এখন আর শুধুই আইন বা আদালতের বিষয় নয়। এটি হয়ে উঠেছে কৌশল, হিসাব ও শক্তির খেলা। আদালতের নির্দেশ কেনো ‘হিমাগারে’—তার উত্তর তাই খুঁজতে হয় রাজনৈতিক অঙ্কে। যেখানে উভয় পক্ষই নিজের স্বার্থ অনুযায়ী খেলছে, এবং আইনি প্রক্রিয়া রয়ে যাচ্ছে একপাশে। সত্যিকার অর্থে নিরপেক্ষ নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য শুধু তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন নয়, দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং আদালতের কার্যকর স্বাধীনতা।
পাঠকের প্রতি প্রশ্ন
আপনি কি মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব? মন্তব্যে জানান আপনার মতামত।
Post a Comment