উজবেকিস্তানে দাড়ি ও বোরকা নিষিদ্ধ: ধর্মীয় বিশ্বাস নাকি রাষ্ট্রীয় শাসনের আধুনিক রূপ?

 

প্রতীকী ছবি

প্রেক্ষাপট

মধ্য এশিয়ার মুসলিমপ্রধান দেশ উজবেকিস্তান আবারও আন্তর্জাতিক নজরে এসেছে। এদেশের সরকার “মুসলিম স্টাইলের দাড়ি” রাখা নিষিদ্ধ করেছে এবং কেউ এই আইন লঙ্ঘন করলে তাকে ৪০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত জরিমানা গুনতে হয়। এমনকি পুলিশ চাইলে জোরপূর্বক দাড়িও কেটে দিতে পারে। পাশাপাশি এখন শোনা যাচ্ছে, বোরকা পরাও আইনত অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

প্রথমে সামাজিক ও প্রশাসনিক মাত্রায় সীমিত থাকলেও, ২০২৩ সালের শেষদিক থেকে এইসব নিষেধাজ্ঞা সরকারি আইন ও রাষ্ট্রীয় দমননীতির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

 

দাড়ির বিরুদ্ধে অভিযানের সূচনা ও কার্যকারিতা

২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে উজবেক সরকার এমন একটি আইন সংশোধন করে, যেখানে বলা হয়:

·       “মুখের এমন অঙ্গসজ্জা, যা সনাক্ত করাকে কঠিন করে তোলে এবং জনসাধারণের মধ্যে চরমপন্থার বার্তা বহন করে—তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।”

এই ধারার আওতায় ‘দাড়ি’ রাখা হলে সেটা ১ থেকে ৫.১ মিলিয়ন উজবেক সোম (প্রায় ৪০০ ডলার) পর্যন্ত জরিমানার আওতায় পড়ে।
পুলিশ চাইলে তৎক্ষণাৎ দাড়ি কেটে ফেলতে পারে এবং কেউ এর প্রতিবাদ করলে “হুলিগানিজম” বা “সরকারবিরোধী আচরণ” হিসেবে মামলা দেওয়া হয়।

২০২৪ এবং ২০২৫ সালেও এই আইন কার্যকর থাকায় দেশের নানা জায়গা থেকে দাড়ি রাখা মুসলিম পুরুষদের হয়রানির খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষত রাজধানী তাসখন্দ, নমাঙ্গান, জায়জ্জাখআন্দিজান এলাকায় বহু ধর্মপ্রাণ মুসলমান জেল ও জরিমানার মুখোমুখি হচ্ছেন।

 

বোরকা নিষিদ্ধ: স্বাধীনতা না শৃঙ্খলা?

২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে উজবেক প্রেসিডেন্ট শাভকাত মিরজিয়ায়োভ একটি নতুন নির্দেশনায় জনসম্মুখে মুখ ঢেকে রাখার যেকোনো পোশাক—যেমন বোরকা বা নিখুঁতভাবে ঢাকা নিকাব নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

  • এই নির্দেশে বলা হয়, কেউ যদি রাস্তায় বা কোনো জনসমাবেশে মুখ ঢাকা অবস্থায় থাকেন, তাহলে ৪০০–৮০০ ডলার পর্যন্ত জরিমানা করা হবে।
  • স্কুল, কলেজ ও সরকারি অফিসে হিজাব ও ধর্মীয় পোশাক বহু আগেই নিষিদ্ধ।

সরকারি ভাষ্যে বলা হচ্ছে, “এটি নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপ”, কিন্তু সমালোচকরা বলছেন—এই নীতিগুলো মূলত ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ ও নিঃশব্দ করতে ব্যবহৃত হচ্ছে।

 

ধর্মনিরপেক্ষতা নাকি রাষ্ট্রীয় আধিপত্য?

৯০ শতাংশ মুসলিম অধ্যুসিত উজবেকিস্তান ইসলামী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে পূর্ণ একটি দেশ হলেও ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই ‘ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র’ হিসেবে পথচলা শুরু করে। কিন্তু বাস্তবে ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা এখানে প্রায়ই রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধে রূপ নেয়

ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশের স্বাভাবিক মাধ্যম—যেমন দাড়ি রাখা, বোরকা পরা, মসজিদে বেশি যাওয়া, ইসলামিক শিক্ষা গ্রহণ—সবই ‘চরমপন্থা’র সম্ভাব্য ইঙ্গিত হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। ফলে সাধারণ মুসলমানের স্বাভাবিক ধর্মীয় আচরণকেও এখন বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব হিসেবে দেখা হচ্ছে।

 

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও মানবাধিকার প্রসঙ্গ

জাতিসংঘ, Human Rights Watch, ও Amnesty International ইতিমধ্যে উজবেকিস্তানের এসব পদক্ষেপের বিরুদ্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
তাদের বক্তব্য:

·       “একজন মানুষ তার ধর্মবিশ্বাস প্রকাশ করতে পারবে না—এমন রাষ্ট্রীয় বাধা মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থী।”

বিশেষ করে জোর করে দাঁড়ি কেটে দেওয়া বা মুখে হিজাব খুলে দেওয়ার মতো শারীরিক হস্তক্ষেপকে আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দনীয় ও অপমানজনক আচরণ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।

 

সারসংক্ষেপ

বিষয়

সময়

                     বর্তমান অবস্থা

দাঁড়ি নিষিদ্ধ

   অক্টোবর ২০২৩

বলবৎ,         জরিমানা ও জোরপূর্বক শেভিং

বোরকা নিষিদ্ধ

   নভেম্বর ২০২৩

বলবৎ,         মুখ ঢাকা পোশাকে জরিমানা

হিজাব নিয়ন্ত্রণ

   ২০২১–২০২৩

                 শিক্ষা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিষিদ্ধ

 

উপসংহার

উজবেকিস্তানের ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা শুধু একটি রাজনৈতিক আদর্শ নয়—এটি রাষ্ট্রীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার এক পরিপক্ব পদ্ধতি। দাড়ি, বোরকা, হিজাব—এসব ধর্মীয় চিহ্নর আড়ালে যদিও অনেক চরমপন্থী, উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, ফলে ধর্মীয় চিহ্নকে ‘চরমপন্থার’ প্রতীক বানিয়ে সাধারণ মুসলমানদের উপর চাপ প্রয়োগ এখন স্পষ্ট বাস্তবতা। তাইবলে ঢালাওভাবে সবাইকে দোষী সাব্যস্ত করা কতোটা যৌক্তিক?

একটি রাষ্ট্র নিজেকে নিরাপদ ও আধুনিক রাখতে চায়—তা স্বাভাবিক। কিন্তু সেই নিরাপত্তার অজুহাতে ধর্মীয় স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া, মানুষকে তাদের পরিচয়ের জন্য শাস্তি দেওয়া, কিংবা জোর করে দাড়ি কেটে দেওয়া—এসব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটি শুধু ইসলামের বিরুদ্ধে নয়—বরং ব্যক্তি স্বাধীনতার বিরুদ্ধেই এক নিরব যুদ্ধ।

উল্লেখ্য, এই উজবেকিস্তানেই জন্মগ্রহণ করেন প্রখ্যাত হাদিস গ্রন্থ “সহিহ আল-বুখারী” গ্রন্থের রচয়িতা ইমাম বুখারী (রঃ)।

আপনি কী মনে করেন? রাষ্ট্র কি সত্যিই চরমপন্থা ঠেকাচ্ছে, নাকি শান্ত ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকেও চেপে ধরছে? আপনার মতামত নিচে কমেন্ট করুন।

 




Post a Comment

Previous Post Next Post