সমাজে
একটি গুজব ছড়িয়ে আছে—“রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামের লেখা চুরি করে নোবেল
পুরস্কার পেয়েছিলেন!” এই দাবিটি কতটা সত্য? আসুন, বিষয়টি একটু যুক্তি ও ইতিহাসের
আলোকে বিশ্লেষণ করি।
প্রথমেই
স্পষ্ট করে বলা জরুরি—এই অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং মিথ্যা। এটি
সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি অসত্য গুজব, যার কোনো প্রমাণ নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তার নিজের মৌলিক সাহিত্যকর্মের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন এবং তার
সাহিত্যসাধনার স্বীকৃতি কেবল ভারতবর্ষেই নয়, বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত।
বয়স ও সাহিত্যচর্চার সময়কাল: গুজব ভাঙার প্রথম ধাপ
- রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন ০৭
মে ১৮৬১ সালে, আর কাজী নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন ২৪ মে ১৮৯৯ সালে।
অর্থাৎ, তাদের মধ্যে বয়সের পার্থক্য ছিল ৩৮ বছর।
- রবীন্দ্রনাথ
মাত্র ৮ বছর বয়সে কবিতা লেখা শুরু করেন, তার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৮৭৮
সালে—নজরুলের জন্মেরও ২১ বছর আগে।
- অন্যদিকে নজরুল
সাহিত্যচর্চা শুরু করেন লেটোর দলে পালা ও গান রচনার মাধ্যমে, তবে তার সাহিত্য
প্রকাশ শুরু হয় ১৯১৯ সালে, যখন তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন।
নোবেল পুরস্কার ও বাস্তবতা
- রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পান ১৯১৩ সালে, তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘গীতাঞ্জলি’র
ইংরেজি অনুবাদের জন্য। এই গ্রন্থের কবিতাগুলো মূলত ১৯০৮–১৯০৯ সালের মধ্যে
বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং ১৯১০ সালে তা গ্রন্থরূপে প্রকাশিত হয়।
- তখন নজরুলের
বয়স ছিল মাত্র ১১ বছর। তিনি তখন স্কুলে পড়ার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু
দারিদ্র্যের কারণে কখনো লেটোর দলে, কখনো কবিয়াল দলে, কখনো রেলওয়ের গার্ডের
বাড়িতে খানসামা, আবার কখনো আসানসোলের একটি রুটির দোকানে কাজ করতেন।
- বাস্তবতা হলো,
নোবেল প্রাপ্তির সময় নজরুল সাহিত্যের জগতে প্রবেশই করেননি।
সাহিত্যকর্মের প্রকৃতি: আলাদা ধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি
- রবীন্দ্রনাথের
সাহিত্য
মূলত আধ্যাত্মিকতা, প্রকৃতি, মানবিক দর্শন ও ভাবনামূলক কাব্যনির্ভর।
- নজরুলের সাহিত্য বিদ্রোহ, বৈষম্যবিরোধিতা,
সাম্যবাদ ও প্রেমনির্ভর; তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশিত হয়
১৯২২ সালে—নোবেল প্রদানের প্রায় এক দশক পরে।
গুজবের অতিরিক্ত দুর্বলতা
- কেউ কেউ গুজব ছড়াতে
গিয়ে নজরুলের স্ত্রী প্রমিলা দেবী (আশালতা সেনগুপ্তা)–র সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের
সম্পর্ক টানতে চান, যা সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসূত ও ভিত্তিহীন। রবীন্দ্রনাথ এই
সম্পর্কের কোনো ভূমিকা বা সম্পৃক্ততায় ছিলেন না।
নোবেল প্রক্রিয়া সম্পর্কে বাস্তবতা
- নোবেল পুরস্কার
একটি গুরুত্বপূর্ণ ও কঠোর বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রদান করা হয়।
সাহিত্য চুরির মতো অভিযোগ এই প্রক্রিয়ায় টিকে থাকতে পারে না। ১৯১৩ সালে
রবীন্দ্রনাথ প্রথম এশীয় হিসেবে এই পুরস্কার লাভ করেন এবং বিশ্বসাহিত্যে
ভারতীয় ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেন।
শেষকথা: ইতিহাসকে বিকৃত করে গুজব ছড়াবেন না
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর কাজী নজরুল ইসলামের লেখা চুরি করে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন—এই বক্তব্য একটি
গুজব এবং ইতিহাসবিকৃতি। বরং এই দুই মহান কবি একে অপরের প্রতি ছিল অত্যন্ত
শ্রদ্ধাশীল। নজরুল একাধিকবার রবীন্দ্রনাথের প্রতি তার ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
করেছেন, আর রবীন্দ্রনাথ নজরুলের প্রতিভা সম্পর্কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন।
তথ্য ও ইতিহাসের ভিত্তিতে গুজবের জবাব দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। অতএব, আসুন যুক্তি ও সত্যের পক্ষে থাকি।
You may also laikeঃ
নানা পাটেকর এর দান
إرسال تعليق