মৌমাছির কামড়ে একদিকে মৃত্যু, অন্যদিকে জীবন: সঞ্জয় কাপুর ও এলি লোবেলের বিপরীত পরিণতি

 


প্রকৃতির খেয়াল বরাবরই রহস্যময়। একেই বলে—“একই ছায়ার নিচে কেউ পায় শান্তি, কেউ পায় অন্ধকার।” সাম্প্রতিক দুটি বাস্তব ঘটনার দিকে তাকালে, এই সত্য যেন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একদিকে, ভারতের এক ধনকুবের সঞ্জয় কাপুর প্রাণ হারালেন মৌমাছির কামড়ে। আর অন্যদিকে এলি লোবেল নামের এক মার্কিন নারী জীবন ফিরে পেলেন সেই একই মৌমাছির দংশনে। যেন একই ছুরির এক পাশে মৃত্যু, অন্য পাশে মুক্তি।

 

সঞ্জয় কাপুর: এক কামড়েই শেষ

সঞ্জয় কাপুরের ঘটনা আগেই বর্ণনা করেছি। এখানে সামান্য উদ্ধৃতি।

ভারতের বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী সঞ্জয় কাপুরের মৃত্যু ঘটে একটি মৌমাছির দংশনে। তিনি ছিলেন চৌদ্দ হাজার কোটি টাকার মালিক। অথচ জীবনের বিনিময়ে তাঁকে হার মানতে হলো প্রকৃতির ক্ষুদ্র এক প্রাণীর কাছে। রিপোর্ট বলছে, তাঁর শরীরে মৌমাছির বিষে অ্যালার্জি ছিল এবং সময়মতো চিকিৎসা না পাওয়ায় এনাফিল্যাক্সিস শকে তাঁর মৃত্যু ঘটে।

এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সম্পদ বা প্রভাব দিয়ে প্রকৃতির নিয়মকে আটকানো যায় না। সময় মতো চিকিৎসা এবং সচেতনতা—এটাই জীবনের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা।

 

এলি লোবেল: মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা

অন্যদিকে, এলি লোবেলের জীবন যেন অলৌকিক এক উপন্যাস। লাইম ডিজিজে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে বেঁচে ছিলেন একপ্রকার চলন্ত ছায়ার মতো। শেষমেশ যখন সব আশার সীমানা পার করে স্বেচ্ছামৃত্যুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখনই মৌমাছির হঠাৎ এক আক্রমণ যেন তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলো।

বিজ্ঞান বলছে, মৌমাছির বিষে থাকা মেলিটিন নামের এক পেপটাইড উপাদান এলির শরীরে থাকা লাইম ডিজিজের জন্য দায়ী বোরেলিয়া ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে ফেলে। মৌমাছির বিষে মৃত্যু নয়, বরং এলির হয়েছিল পুনর্জন্ম।

 

এলি লোবেলের ঘটনার পূর্ণ বিবরণ

“এলি লোবেলের বয়স ছিলো মাত্র ২৭ বছর, যখন তিনি জঙ্গলে হাঁটতে গিয়ে পোকার কামড় খান। আপাতদৃষ্টিতে খুবই সামান্য একটা কামড়, একটু জ্বালাপোড়া ও লাল ত্বক - তাই এলি তেমন পাত্তা দেননি। কিন্তু মাস ঘুরতেই দেখা গেলো এলির সারা শরীর জুড়ে অসহ্য ব্যাথা। ক্রমাগত কাশি ও শ্বাসকষ্ট। এবং সেই সাথে তাঁর স্মৃতিশক্তিও কমে আসতে লাগলো। এলি ডাক্তারের কাছে গেলেন। কেউ বললেন ফ্লু, কেউ বললেন ভাইরাল ইনফেকশন, কেউ বললেন আর্থ্রাইটিস, আবার কারো মতে এটা ইমিউন সিস্টেমেরই সমস্যা। কিন্ত কেউই সল্যুশন দিতে পারলেননা।

ধীরে ধীরে এলির অবস্থা খারাপের দিকে যেতে লাগলো। একজন উৎসাহী গবেষক ও তিন সন্তানের মমতাময়ী মা, টগবগে চঞ্চল তরুণী এলি লোবেল শেষপর্যন্ত শরণাপন্ন হলেন হুইলচেয়ারের। স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেননা, শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকেনা। তার ওপর তেমন কিছু মনেও রাখতে পারেননা। সবসময় থাকেন ঘোরের ওপর। সারা শরীরের জোড়াগুলোতে ব্যাথা তো আছেই, হাত পা নাড়াতে গেলে মনে হয় যন্ত্রণায় এখুনি প্রাণ হারাবেন।

এক বছর আগে যেখানে এলি পুরো সংসার আর বন্ধুমহল মাতিয়ে রাখতেন, কয়েক মাস পর দেখা গেলো তার আর একটা জড়বস্তুর মাঝে বিশেষ কোনো তফাত নেই! এলি উত্তর পেলেন প্রায় একবছর পরে এসে। বোরেলিয়া গণের একটি ব্যাকটেরিয়া। পোকার কামড়ের মাধ্যমে তাঁর শরীরে ঢুকেছে এই ব্যাকটেরিয়া। আর ছড়িয়ে দিয়েছে লাইম ডিজিজ। রক্তশোষক পোকার কামড়ে এই রোগ ছড়ায়। বোরেলিয়া গণের ব্যাকটেরিয়া শরীরের নার্ভ সিস্টেম আক্রমণ করে। ফলে শরীরের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আর প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস হয়ে যায়। তবে শুরুর দিকে চিকিৎসা করলে সারানো সম্ভব। কিন্ত এলির এক বছর পার হয়ে গিয়েছিলো।

এলি মোট ১৫ বছর যুদ্ধ করলেন। ২৭ থেকে ৪২। তরুণী থেকে মধ্যবয়স্কা। ছেলেমেয়েও বড় হয়ে গেছে। কিন্তু এলি আগের মতন। একটা কেয়ারটেকার রেখে দিয়েছেন। সে হুইলচেয়ার ধরে ঘোরায়। আর বাসায় থাকলে বেডে শুয়ে থাকেন। স্মৃতিশক্তিও সব ঝাপসা। এভাবে কতদিন বেঁচে থাকা যায়? এলি লোবেল স্বেচ্ছামৃত্যুর ডিসিশন নিলেন। তিনি জড়বস্তু হয়ে বেঁচে থাকতে চান না। ডাক্তার তিন মাস সময় দিয়েছিলেন। আর তিন মাস। এরপরই নিজেকে শেষ করে ফেলবেন এলি। জড়পদার্থ হয়ে অন্যকে কষ্ট দিয়ে বেঁচে থাকার চাইতে সে ই ভালো।

জীবনের শেষ কয়েকটা দিন পার করার জন্য এলি পাড়ি জমালেন ক্যালিফোর্নিয়ায়। ক্যালিফোর্নিয়ার এক সূর্যস্নাত সকাল। এলি কেয়ারটেকারকে বলে হুইলচেয়ার নিয়ে বাইরে বাগানে এসেছেন। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়েছেন একটি দেয়াল ধরে। আর তাকাচ্ছেন সোনালী সূর্যের দিকে, নীল আকাশের দিকে, সবুজ প্রকৃতির দিকে। কয়েক দিন পর সবাইকে বিদায় জানিয়ে অন্ধকারে পাড়ি জমাতে হবে। ঠিক এমনসময় একটা দুর্ঘটনা ঘটলো!

হঠাৎই একটা মৌমাছি এসে কামড় বসালো এলির কপালে। কী হচ্ছে বুঝে উঠার আগেই একঝাঁক মৌমাছি এসে ঘিরে ফেললো এলিকে। আর শুরু করলো দংশন। কেয়ারটেকার হুইলচেয়ার ফেলেই ভাগলো। এলি যেহেতু একপ্রকার প্যারালাইজড, তাঁর পালানোর সৌভাগ্য হলোনা। দাঁড়ানো থেকে বসে পড়লেন! শ’য়ে শ’য়ে মৌমাছি ধেয়ে এলো তাঁর দিকে। কামড়ে কামড়ে কিছুক্ষণের মাঝেই জ্ঞান হারালেন এলি। এলির মৌমাছির বিষে জন্মগত এলার্জি ছিল। তারওপর অলরেডি ভয়াবহ লাইম ডিজিজে প্রায় মরমর অবস্থা। ফলে এই আক্রমণ এলির জন্য প্রাণঘাতীই বলা চলে!

মৌমাছি তাড়িয়ে এলিকে সরিয়ে তাঁর পরিবার দ্রুত যোগাযোগ করলো হাসপাতালে! কিন্তু জ্ঞান ফিরে এলে এলি জানালেন - এই তার ভবিষ্যৎ। তিনি মরতে চেয়েছেন, সৃষ্টিকর্তা মৃত্যুদূত পাঠিয়েছেন মৌমাছির ছদ্মবেশে। অতএব, তিনি শান্তিতে মরতে চান। এলি হাসপাতালে গেলেননা। বাসাতেই রয়ে গেলেন এবং প্রতিমুহূর্তে ক্ষণ গুণতে লাগলেন কবে মরণ আসবে আর সব জ্বালা-যন্ত্রণা মিটিয়ে দিয়ে তাঁকে নিয়ে যাবে। কিন্তু সেটা হলোনা। বরং হলো আরো অদ্ভুত কিছু।

যমে মানুষে টানাটানিতে অর্ধমৃত এলি লোবেল ঠিকই বেঁচে রইলেন। অদ্ভুত এক জ্বরে পুড়ে যেতে লাগলো তাঁর শরীর। এই জ্বর মৌমাছির বিষের ব্যাথাও নয়, নয় লাইম ডিজিজের ফলাফল। একসময়কার গবেষক এলি বুঝলেন, এই জ্বর শরীরের ভেতর হয়ে চলা এক যুদ্ধের ফলাফল। নিশ্চয়ই এক অজানা বন্ধু এক চেনা শত্রুকে নিষ্ক্রিয় করছে।

তিনদিন পার হলো। এলি তখনও বিছানায়। বিছানায় শুয়েই খুব অদ্ভুত কিছু জিনিস খেয়াল করলেন তিনি। শরীরের জয়েন্টে জয়েন্টে যে ব্যাথা ছিলো তা অনেকটাই কমে এসেছে। হাত পা ইচ্ছামত নাড়াতে পারছেন। আস্তে আস্তে হাঁটতেও পারছেন, কোনো সমস্যা হচ্ছেনা। মাথা কেমন যেন হালকা হয়ে গেছে। ভাসাভাসা ব্যাপারটা আর নেই। অনেক স্মৃতিই মনে পড়ছে। কয়েক সপ্তাহের মাথায় এলি লোবেল অনেকটাই সুস্থ হয়ে গেলেন। কোথায় লাইম ডিজিজ কিসের কি। হুইলচেয়ার ফেলে এলি তখন পুরোদমে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। আর ভেবে চলেছেন কাহিনী কী হলো।

এলি লোবেল তুখোড় গোয়েন্দার মতই কাহিনীর রহস্য উদ্ধার করেছিলেন। বড়ই অদ্ভুত সেই রহস্য। মৌমাছির বিষে রয়েছে মেলিটিন নামের একটি পেপটাইড উপাদান। বিষে যে ব্যাথাটা হয় তার একটা বড় কারণ এই মেলিটিন। এলির শরীরে যখন বিষের সাথে মেলিটিন প্রবেশ করলো তখন তা মুখোমুখি হলো রক্তে ভেসে থাকা মিলিয়ন বিলিয়ন বোরেলিয়া ব্যাকটেরিয়ার। মেলিটিনের সংস্পর্শে আসা মাত্রই ব্যাকটেরিয়া গুলো প্যারালাইজড হয়ে গেলো। কোষের বাইরের পর্দা দ্রুত গলে যেতে লাগলো আর গণহারে মারা পড়তে লাগলো শয়তান বোরেলিয়া। এভাবেই মৌমাছির বিষ সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুললো জীবনের আশা ছেড়ে দেয়া এলি লোবেলকে।

সুস্থ হবার পর এলি লাইম ডিজিজের প্রতিষেধক হিসেবে মৌমাছির বিষ ব্যবহারের ওপর ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করেন। যোগাযোগ করেন বী ফার্ম থেকে লাইম ডিজিজের গবেষকসহ অনেকের সাথে। তাঁর প্রচেষ্টায় এই অদ্ভুত প্রতিষেধক আলোর মুখ দেখে। বিজ্ঞানীরা এখন চেষ্টা চালাচ্ছেন কিভাবে মেলিটিন এক্সট্রাক্ট করে বোরেলিয়া সম্পূর্ণ ধ্বংস করা যায়। পুরো বিষয়টি এখন গবেষণার পর্যায়ে আছে।

প্রকৃতি আমাদের জন্য এখনো অবাক হওয়ার উপাদান জমিয়ে রেখেছে। ক্ষণে ক্ষণে সারপ্রাইজ! তাই কেউ বেঁচে থাকার আশা নিয়ে প্ল্যানমাফিক দিন শুরু করলেও দিনশেষে দেখা যায় সে মর্গে এক কোণায় পড়ে আছে। আর কেউবা জড় হয়ে বেঁচে থাকতে চায় না বলে মৃত্যুর কাছে ধর্ণা দিলেও দেখা যায় হুট করে একদিন সে হেসেখেলে বেড়াচ্ছে মুক্ত পাখির মতন! প্রকৃতি সারপ্রাইজে ভরা। জীবনও সারপ্রাইজে ভরা। কখন কী আসে বলা যায়না। তাই হাল ছাড়া যাবেনা। কারণ এই দুঃখভরা ব্যাকটেরিয়ার সাগরে আপনাকে উদ্ধার করতে বিষাক্ত মৌমাছিরা হয়তো চলে আসতেও পারে - কেই বা বলতে পারে?”

 

উপরে বর্ণিত ঘটনা দুটির তুলনামূলক বিশ্লেষণ: একই ঘটনা, ভিন্ন পরিণতি

বিষয়

সঞ্জয় কাপুর

এলি লোবেল

মৌমাছির কামড়ের ফল

মৃত্যু

জীবন রক্ষা

মৌমাছির বিষে প্রতিক্রিয়া

এলার্জিক শক, হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে মৃত্যু

ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস, রোগমুক্তি

প্রতিক্রিয়ার ধরন

তাত্ক্ষণিক ও প্রাণঘাতী

ধীরলয়ে কিন্তু কার্যকরী

চিকিৎসা

সময়মতো না পাওয়ায় মৃত্যু

চিকিৎসা না নিয়েও অলৌকিক উপশম

ফলাফল

জীবনহানি

নতুন জীবন ও গবেষণার উৎসাহ

এই বিপরীত চিত্রটি আমাদের একটি গভীর উপলব্ধির দিকে নিয়ে যায়: প্রতিকৃতি নির্ভর করে কেবল ঘটনাতেই নয়, বরং শরীর, সময়, চিকিৎসা ও প্রস্তুতির ওপরও।

 

প্রকৃতির পাঠ: নিয়ন্ত্রণ নয়, বোঝার চেষ্টা

এই দুটি গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতি কখনোই পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যায় না। তবে, তার ভাষা বোঝার চেষ্টা করলে সে কখনো মৃত্যুর হাত ধরে নিয়ে যায়, কখনো মুক্তির পথ দেখায়।

সঞ্জয় কাপুরের মৃত্যু যেমন সতর্কতার অভাবে ঘটে, এলি লোবেলের বেঁচে ফেরা তার গবেষণামনস্কতা এবং অভিজ্ঞতাকে আশীর্বাদে পরিণত করে।

 

উপসংহার

প্রকৃতি আমাদের ধ্বংস করতে পারে আবার আমাদের রক্ষা করতেও পারে। তবে চাবিকাঠি হলো — সচেতনতা, বিজ্ঞান, ও আত্মবিশ্বাস। মৌমাছির কামড়ে কেউ ধ্বংস হয়, কেউ গড়ে তোলে নতুন চিকিৎসা পদ্ধতির সম্ভাবনা।

এলি লোবেলের অভিজ্ঞতা একদিকে যেমন বিস্ময়কর, তেমনি বিজ্ঞানচর্চার জন্য উৎসাহব্যঞ্জক। অন্যদিকে সঞ্জয় কাপুরের মৃত্যু আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সবচেয়ে ছোট শত্রুও যদি অবহেলিত হয়, সে প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।

তাই জীবন যতই অপ্রতিরোধ্য মনে হোক, শেষ কথা বলে প্রকৃতি—যার হাতে রয়েছে সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ।


#জীবন_ও_প্রকৃতি #মৌমাছি #লাইম_ডিজিজ #সঞ্জয়_কাপুর #এলি_লোবেল #অবিশ্বাস্য_বাস্তবতা


Post a Comment

Previous Post Next Post