![]() |
ভোলকার টুর্ক |
জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভোলকার টুর্ক বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের সুযোগ তৈরি করে আইন সংশোধনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এতে গণতন্ত্র, মতপ্রকাশ ও সংবিধানের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
প্রেক্ষাপট: নতুন বাস্তবতা, নতুন বিতর্ক
২০২৪ সালের শেষভাগে ভয়াবহ সহিংসতা ও জনগণের গণআন্দোলনের মুখে দীর্ঘদিনের শাসকদল আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারায়। এরপর একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই সরকার গণতন্ত্র, জবাবদিহি ও মানবাধিকারের নতুন সূচনা করার প্রতিশ্রুতি দেয়।
কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই নতুন সরকার কিছু আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়, যার মাধ্যমে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের সুযোগ তৈরি হয়। এটিই এখন আন্তর্জাতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু।
কীসের ওপর উদ্বিগ্ন ভোলকার টুর্ক?
জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ভোলকার টুর্ক সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেছেন:
“বাংলাদেশ সরকার রাজনৈতিক সংগঠনের দায় নির্ধারণ ও নিষিদ্ধ করার যেসব আইন সংশোধন করছে, তা মৌলিক স্বাধীনতা, মতপ্রকাশ ও সংগঠিত হওয়ার অধিকারে সরাসরি হস্তক্ষেপ।”
তিনি আরও বলেন,
“গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা চূড়ান্ত পথ—এর আগে সব ধরনের বিকল্প রাজনৈতিক, আইনি ও বিচারিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে।”
সংশোধিত আইনসমূহ: সংক্ষেপে বিশ্লেষণ
১. আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ (সংশোধিত)
-
আগে কেবল ব্যক্তিকেই দায়ী করা যেত। এখন দল বা সংগঠনের নামেও অভিযোগ গঠন করা সম্ভব।
-
সংশ্লিষ্ট দলটির “প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা, উস্কানি বা জ্ঞাতসারে মদদ” থাকলে পুরো সংগঠনের নিবন্ধন বাতিলের সুযোগ রাখা হয়েছে।
২. সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ (সংশোধিত)
-
রাজনৈতিক বা ধর্মীয় সংগঠনের মাধ্যমে সহিংসতা সংঘটিত হলে সেই সংগঠনের সম্পদ জব্দ, নিষিদ্ধকরণ বা সদস্যপদ বাতিল করা সম্ভব।
৩. রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালা, ২০০৮ (সংশোধিত ২০২5)
-
দলটির “গণতন্ত্রবিরোধী, সংবিধানবিরোধী বা স্বাধীনতা যুদ্ধবিরোধী” কার্যক্রম থাকলে নিবন্ধন বাতিলযোগ্য।
বাংলাদেশের সংবিধানে কী আছে?
অনুচ্ছেদ ৩৮ – সমিতি গঠন ও সংগঠিত হওয়ার অধিকার:
“প্রত্যেক নাগরিক শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে সমিতি বা সংঘ গঠনের অধিকার ভোগ করবেন।”
অনুচ্ছেদ ৩৯ – চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, ও বাক্স্বাধীনতা:
“প্রত্যেক নাগরিকের চিন্তা, বিবেক ও বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা হইবে।”
→ এই অধিকারগুলো সীমাবদ্ধ করার ক্ষেত্রে সরকারকে “যুক্তিসংগত কারণ” ও “আদালতের অনুমোদিত প্রক্রিয়া” অনুসরণ করতে হয়।
আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ ও উদাহরণ
দেশ | নিষিদ্ধ দল/সংগঠন | প্রেক্ষাপট |
---|---|---|
জার্মানি | ন্যাজি পার্টি (NSDAP) | গণহত্যা ও ফ্যাসিবাদ-পরবর্তী যুগে চিরতরে নিষিদ্ধ |
তুরস্ক | কুর্দিশ HDP, Welfare Party | সংবিধানবিরোধী কার্যক্রম |
মিশর | মুসলিম ব্রাদারহুড | সামরিক অভ্যুত্থানের পর নিষিদ্ধ |
বাংলাদেশ | জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল | মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা |
তবে এসব সিদ্ধান্তও আন্তর্জাতিক মহলে বিতর্কিত ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত তুরস্কের দল নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে একাধিকবার রায় দিয়েছে।
সম্ভাব্য প্রভাব
-
বিরোধী মতকে দমন:
পুরো সংগঠনকে দায়ী করলে যারা রাজনীতি করে না বা কেবল ভোট দেয় তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে মতপ্রকাশের অধিকার খর্ব হয়। -
নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা:
বহুদলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয় না। তা আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। -
গোপন প্রতিরোধের ঝুঁকি:
প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে সমর্থকেরা বিকল্প বা উগ্রপন্থায় যেতে পারে—যা স্থিতিশীলতা নষ্ট করে।
উপসংহার
ভোলকার টুর্কের বক্তব্য শুধু জাতিসংঘের পক্ষ থেকে একটি আনুষ্ঠানিক উদ্বেগ নয়—এটি ভবিষ্যতের জন্য একটি সতর্কবার্তা। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে যদি দীর্ঘস্থায়ী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে হয়, তবে সংকোচন নয়, সম্প্রসারণই হতে হবে নীতিগত রূপান্তরের দিকনির্দেশনা।
রাজনৈতিক দল, সমর্থক ও নাগরিক সমাজ—সবাইকে আইনের কাঠামোয় আনতে হলে নিষেধ নয়, সংলাপ ও ন্যায়বিচারই হোক আমাদের পথ।
আপনার মন্তব্য যুক্ত করতে চান?
এই ব্লগে আপনার মতামত জানাতে পারেন নিচের কমেন্ট সেকশনে।
Post a Comment