শোনা মানে কি শুধু শ্রবণেন্দ্রিয়ে কিছু প্রবেশ করা নাকি এর বিশেষ তাৎপর্য আছে?

 

ছবিঃ প্রতীকী

আমরা প্রতিদিন অসংখ্য শব্দ শুনি—মানুষের কথা, যানবাহনের আওয়াজ, পাখির ডাক, অথবা দূরের কোনো ভাষার অনুরণন। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই “শোনা”গুলো কি সবই প্রকৃত শোনা? ভাষা না বুঝে কেউ কিছু বললে, সেটা আমরা শুনি ঠিকই, কিন্তু আদৌ কি বুঝি? তাহলে কি শুধুমাত্র শব্দ কানে পৌঁছানোই "শোনা"? নাকি "শোনা" আরও কিছু গভীর জিনিস?


এই লেখায় আমরা ‘শোনা’ শব্দটির মানে, তার বহুমাত্রিক রূপ, এবং ভাষাগত উপলব্ধির অনুপস্থিতিতে ফলফল কি, তার অর্থবহ বিশ্লেষণ করব।


 

"শোনা"র মৌলিক সংজ্ঞা

শোনা হচ্ছে—

কর্ণেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে শব্দগ্রহণ ও মস্তিষ্কে তার অনুধাবন।

তবে এই সংজ্ঞা নিজের মধ্যেই এক প্রশ্ন তুলে ধরে—শুধু শব্দ কানে পৌঁছালেই কি সেটি শোনা? যদি সেই শব্দের অর্থ না বুঝি, তাহলেও কি আমরা শুনেছি?

উদাহরণ:

  • আপনি যদি ফরাসি ভাষা না জানেন এবং কেউ আপনাকে ফরাসি কিংবা আরবীতে কিছু বলে, আপনি শব্দগুলো শুনবেন ঠিকই। কিন্তু বুঝবেন না কিছুই। ফরাসি কিংবা আরবী ভাষায় যদি বলা হয়, আপনার সামনে ড্রেন; আপনি বুঝবেন না, ড্রেনে গিয়ে পড়বেন।
  • তাহলে প্রশ্ন জাগে—আপনি কি সত্যিই শুনলেন? নাকি শুধু শব্দ গ্রহণ করলেন?

 

শোনার স্তরভেদ:

শোনাকে একাধিক স্তরে বিশ্লেষণ করা যায়—

স্তর

ধরণ

ব্যাখ্যা

১।

 শারীরিক শোনা

  শব্দ কর্ণে পৌঁছানো মাত্র

 মনোযোগী শোনা

  মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ, তবে অর্থ বোঝার নিশ্চয়তা নেই

 উপলব্ধিমূলক শোনা

  শব্দের তাৎপর্য বোঝা ও মানসিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়া

 আত্মিক শোনা

  শব্দের অন্তর্নিহিত ভাব অনুধাবন ও হৃদয় দিয়ে গ্রহণ

  

 আদেশ/উপদেশ

  যা শোনা হয় তাতে কোনো আদেশ/উপদেশ বা নিষেধ থাকলে তা

  পালন করা

সুতরাং, শুধু শব্দ কানে পৌঁছালেই শোনা সম্পন্ন হয় না। ‘শোনা’ তখনই পূর্ণ হয়, যখন তা বোধে পৌঁছায়

 

ভাষা না বুঝে শোনা কি শোনা নয়?

যদি আমরা কোনো অজানা ভাষায় কিছু শুনি, সেটি কি শোনা হিসেবে গণ্য হবে?

 

না, সেটা পূর্ণ শোনা নয় (বোধগতভাবে):

আপনি যদি সেই ভাষা না বোঝেন, অর্থ না জানেন, তাহলে তাতে অনুভূতিও গড়ে ওঠেনি।
এক্ষেত্রে এটি পূর্ণ শোনা নয়, বরং “আধা-শোনা”ও বলা চলে না।

ভাষা শুধু শব্দের সমষ্টি নয়; ভাষা হচ্ছে অর্থবহনকারী মাধ্যম। আর অর্থ না বুঝলে তা শোনা না শোনা সমান কথা, কারণ সে শোনা আপনার কোনো কাজে আসবে না।

 

শোনার প্রাসঙ্গিকতা সমাজে ও সম্পর্কে

শুধু শব্দ শোনা নয়, বুঝে শোনা—এটাই মানুষে মানুষে বোঝাপড়ার মূল।
একজন মানুষ কাঁদতে কাঁদতে কিছু বলছে। আপনি শব্দগুলো শুনলেন, কিন্তু ভাষা বোঝেন না—তাহলে আপনি তার ব্যথা বুঝবেন না। শব্দ শুনে শ্রবণশক্তি সচল প্রমাণ হলো, কিন্তু মানবিক সংযোগ তৈরি হলো না।

তাই, শোনার ক্ষেত্রে ভাষার জ্ঞান এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।

 

ধর্ম ও দর্শনের আলোকে ‘শোনা’

বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে ‘শোনা’র গুরুত্ব আলাদা করে উল্লেখ করা হয়েছে।

  • কুরআনে বহু স্থানে বলা হয়েছে—

"তারা কি শোনে না? তারা কি বোঝে না?"
এখানে কেবল কানে শোনা নয়, বরং আত্মিকভাবে গ্রহণ করাকেই বোঝানো হয়েছে।

  • হিন্দু ধর্মে বলা হয়—
    • “শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন”—তিনটি স্তরে জ্ঞান অর্জন হয়। অর্থাৎ শুনুন, মননে ধারণ করুন, সেই অনুযায়ী চর্চা করুন।

সুতরাং, দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকেও শোনার মানে শুধু শ্রবণেন্দ্রিয়ের কাজ নয়, বরং বোঝার প্রবণতা।

 

শুনে বোঝা—কেন গুরুত্বপূর্ণ?

  • শিক্ষাক্ষেত্রে: শিক্ষক বলছেন, ছাত্র শুনছে, কিন্তু বুঝছে না—তাহলে পাঠদান ব্যর্থ।
  • বিচারব্যবস্থায়: সাক্ষ্য শোনা মানে শুধু কর্ণে শব্দ নেওয়া নয়, তা বুঝে বিচার করা।
  • সম্পর্কের ক্ষেত্রে: জীবনসঙ্গীর কথা শুনে বুঝতে না পারলে দাম্পত্যে দূরত্ব বাড়ে।

 

উপসংহার:

"শোনা" একটি বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া।
শুধু কর্ণ দিয়ে শব্দ গ্রহণ করাকে শোনা বলা যায়, তবে সেটি "সম্পূর্ণ শোনা" নয়।
যদি ভাষা না বুঝি, তবে আমরা শুধু আওয়াজ শুনি, অনুভব নয়।
শ্রবণ যখন অর্থ ও অনুভবের সাথে যুক্ত হয়, তখনই সেটি প্রকৃত শোনা হয়ে ওঠে।

 

শেষকথা:

আজকের যান্ত্রিক জীবনে সবাই কথা বলে, সবাই কিছু না কিছু শোনে।
কিন্তু ক'জন সত্যিই শোনে?
শোনা মানে শব্দে থেমে না গিয়ে হৃদয়ে পৌঁছানো।
ভাষা, উপলব্ধি, মনোযোগ—এই তিনে গড়ে ওঠে প্রকৃত শোনা।

আপনি যদি বিশ্বাস করেন যে, বুঝে শোনা একটি সামাজিক ও নৈতিক গুণ—তাহলে এই প্রবন্ধটি আপনার মতো অনেক পাঠকের মনে নাড়া দিতে পারে।

Post a Comment

Previous Post Next Post