বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি সিরিজের পঞ্চম পর্ব। আন্তর্জাতিক চাপ,
কূটনৈতিক কৌশল ও বৈদেশিক শক্তির ভূমিকা কতটা প্রভাব ফেলছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে? বিশ্লেষণ
থাকছে এই পর্বে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আন্তর্জাতিক চাপ ও কূটনৈতিক প্রভাব নতুন কিছু নয়। কিন্তু ২০২৪ সালের আগস্টের পর থেকে
যা ঘটছে, তা আন্তর্জাতিক মহলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকার নতুন এক মাত্রা তৈরি
করেছে।
ড. ইউনুস-ঘনিষ্ঠ প্রশাসনের উত্থান, শেখ হাসিনার নেতৃত্বের অবসান,
পশ্চিমা বিশ্ব ও জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রশ্ন—সব কিছু মিলিয়ে এখন বাংলাদেশের
রাজনৈতিক সীমানা যেন শুধু রাজধানী ঢাকায় সীমাবদ্ধ নয়, তা ছড়িয়ে পড়েছে ওয়াশিংটন,
জেনেভা, ব্রাসেলস এবং দিল্লিতেও।
পূর্ববর্তী পর্বঃ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি (পর্ব ৪))
বৈশ্বিক শক্তির ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান
- যুক্তরাষ্ট্র: বারবার মানবাধিকার, অবাধ নির্বাচন ও সুশাসনের আহ্বান জানালেও অনেকেই মনে করেন, তাদের কার্যকর ভূমিকায় দ্বৈততা রয়েছে। ভিসা নিষেধাজ্ঞা ও রাজনৈতিক চাপে তারা ভূমিকা রেখেছে, তবে সরাসরি হস্তক্ষেপে পিছিয়ে আছে।
- ভারত: দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিলেও সঅন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ক্রমাগত ভারত বিদ্বেশ তাদের অবস্থানে পরিবর্তন স্পষ্ট, যদিও অনেকের মতে ‘নন-ইন্টারফেয়ারেন্স’ নীতির আড়ালে বাস্তবে ‘ব্যালান্সিং অ্যাক্ট’ চলছে।
- চীন: সার্বভৌমত্বের নামে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তকে সম্মান করার আহ্বান জানালেও, তারা বিরোধী দমন ও নিয়ন্ত্রিত প্রশাসনের পক্ষে নীরব সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
- রাশিয়াঃ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়িন সরাসরি বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়েচিলো। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়া ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’ নীতিতে চলে। কোনোরূপ সংঘাত ছাড়া কূটনৈতিক কৌশলের লক্ষণই রাশিয়ার মধ্যে পরিস্ফুটিত।
- ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ: গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে চাপ বজায় রাখছে।
জেনেভায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রদর্শনী এরই এক উদাহরণ।
তবে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতিতে প্রভাবশালীদের চাপে অনেক সময় দ্বৈতনীতি অনুসরণ
লক্ষ্য করা যায়।
আন্তর্জাতিক চাপের লক্ষ্য কি?
বিভিন্ন রাষ্ট্র ও জোটের চাপ ও বিবৃতির পেছনে একাধিক লক্ষ্য থাকতে পারে:
- বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা
- ভবিষ্যৎ সরকারে প্রভাব বিস্তার
নিশ্চিত করা
- অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থ
সংরক্ষণ
- ডেমোক্রেসি প্রোমোশনের নামে
নিজের অবস্থানকে বৈধতা দেওয়া
বিদেশি এনজিও ও কূটনৈতিক চ্যানেল
বাংলাদেশে বিদেশি দাতাসংস্থা ও এনজিওগুলোর উপস্থিতি নতুন নয়। কিন্তু
বর্তমান প্রেক্ষাপটে কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘গভীর রাষ্ট্র’ বা ‘ডিপ স্টেট’
নেপথ্য শক্তির সঙ্গে কাজ করছে বলে অনেকেই অভিযোগ করছেন। ২০২৪ এর নির্বাচনের পূর্বে
এবং পরে বিভিন্ন কূটনীতিকদের সাথে গোপন বৈঠক ও বিবৃতির সমন্বয় তারই একটি
ইঙ্গিতবাহী চিত্র।
প্রশ্ন: বিদেশি চাপ কি গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবে?
আন্তর্জাতিক চাপের একটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে—মানবাধিকার লঙ্ঘন ও
দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কিন্তু ইতিহাস বলছে, কূটনৈতিক চাপ কেবল তখনই
কার্যকর হয়, যখন দেশের অভ্যন্তরীণ গণচেতনা ও রাজনৈতিক শক্তিগুলো ঐক্যবদ্ধ থাকে।
বাইরের শক্তির ওপর ভরসা করে দীর্ঘমেয়াদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
উপসংহার
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন একটি ভূরাজনৈতিক দোলাচলে।
পশ্চিমা গণতন্ত্র বনাম পূর্বা-ঘেঁষা কর্তৃত্ববাদ—এই দ্বন্দ্বে বাংলাদেশের মানুষ
কেবল পর্যবেক্ষক হয়ে থাকতে পারে না। নিজেদের নিয়তি নির্ধারণে অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও
চেতনা গড়ে তুলতে না পারলে, বিদেশি স্বার্থই হয়তো রাজনীতির চালক হয়ে উঠবে।
🔜 পরবর্তী পর্ব আসছে:
“নির্বাচনের ভবিষ্যৎ: অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র না নিয়ন্ত্রিত রেজিম?”
إرسال تعليق