সময়ের সংবেদনশীলতা ও আমাদের অসহিষ্ণুতা - সমসাময়িক ভাবনা

 

প্রতীকী ছবি

ভূমিকা

আমাদের সময়টি এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বে আটকে আছে। একদিকে বিপুল তথ্যপ্রবাহ, প্রযুক্তির বিস্তার, অন্যদিকে সমাজে যেন ধীরে ধীরে জমাট বাঁধছে একধরনের সংবেদনশীলতার সংকট। শব্দের প্রতি, চিন্তার প্রতি, মতের প্রতি সহ্যশক্তি দিনদিন কমছে। সহনশীলতা, সংলাপ, শ্রোতা হয়ে ওঠা—এগুলো যেন আজ দুর্লভ গুণ। আমরা এখন খুব দ্রুত ক্ষুব্ধ হই, রেগে যাই, বা কাউকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বাতিল করে দেই।

 

কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই যে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা, তা কাদের মধ্যে গড়ে উঠছে? রাজনীতিবিদদের মধ্যে? ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে? নাকি আমাদের—এই সাধারণ নাগরিক, পাঠক, লেখক, শিক্ষার্থী, শিক্ষক—এই শ্রেণির মধ্যেই তা সবচেয়ে বেশি প্রসার লাভ করছে?

 

মত, মতভেদ ও মনের সংকীর্ণতা

আধুনিক যুগের অন্যতম গর্ব ছিল—মত প্রকাশের স্বাধীনতা। কিন্তু এখন সেই মত প্রকাশই যেন সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। আজ যদি আপনি একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব বা সাহিত্যিক হন এবং কোনো স্পর্শকাতর বিষয়ে নিজের অবস্থান জানান, তাহলে গালাগালি, ট্রল, এমনকি প্রাণনাশের হুমকিও পেতে পারেন।

 

পশ্চিমবঙ্গের একজন নাট্যকার কিছুদিন আগে একটি নাটকে একটি ধর্মীয় রূপক ব্যবহার করেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তা ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের’ অভিযোগে বন্ধ করে দেওয়া হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশে একজন তরুণ লেখক কেবল একটি পুরাণনির্ভর গল্প লিখে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ অপবাদে ভোগেন। এই ঘটনা দুটি ভিন্ন দেশে হলেও ভেতরের সমাজচিত্র প্রায় অভিন্ন—অসহিষ্ণুতা এখন রাষ্ট্র নয়, সমাজের অভ্যন্তরেই জন্ম নিচ্ছে। আর বাংলাদেশে তো এখন অহরহ ঘটছে বিষয়টা। কিছুদিন আগে সরকারের সমালোচনা করায় এক তরুণ ইউটিউবারকে জেলে পূরে রাখা হয়েছে। একজন ধর্মীয় বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করায় তাকে জুতার মালা পরিয়ে সোশাল মিডিয়ায় ছবি ছেড়ে দেয়া হয়েছে- অথচ তিনি মুসলিম।

 

সাহিত্য ও চিন্তার সীমারেখা

সাহিত্য আগে যেখানে মানুষের বিবেক জাগানোর কাজ করতো, সেখানে এখন অনেক ক্ষেত্রেই সাহিত্যকে বানানো হচ্ছে 'নিরাপদ', 'অরাজনৈতিক', 'রুচিসম্মত'—যে সাহিত্য কোনো প্রশ্ন তোলে না, শুধু বিনোদন দেয়। কিন্তু তাতে সাহিত্য কি তার আত্মা হারিয়ে ফেলছে না?

নির্মলেন্দু গুণ এক কবিতায় বলেছিলেন:

“আমার কোনো কবিতা পড়লে তুমি রাগ করো,
আমি চুপ থাকি, জানি কবিতার আগে কিছু না।”

কিন্তু আজ কবিতার কারণেই হয়তো কারও চাকরি যাবে, বইমেলা থেকে বাদ পড়বে, অথবা ‘বয়কট’-এর শিকার হবে।

 

একটা সময় ছিল যখন বুদ্ধদেব বসু বা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা পাঠ করে কেউ কেউ অস্বস্তিতে পড়তেন, কিন্তু তাদের অস্তিত্ব কেউ অস্বীকার করেননি। আজ যদি একজন কবি প্রেম, যৌনতা, ধর্ম বা রাজনীতি নিয়ে লেখেন, তখন তা একমাত্র ‘অপরাধ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়- যেমন; এই অপবাদে মৌলবাদীদের ফতোয়া মাথায় নিয়ে তসলিমা নাসরিন নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। পাঠকের সহনশীলতা, সম্পাদক ও প্রকাশকের সাহস—সবই সংকুচিত।

 

প্রযুক্তি ও বিকৃত প্রতিক্রিয়ার যুগ

আমরা বসে আছি সামাজিক মাধ্যমের সামনে, এক একটি মতামত পোস্ট হচ্ছে—আর আমাদের রাগে চোখ টকটকে হয়ে যাচ্ছে। কেউ লিখেছে, “মোদি সরকারের নীতিতে ভুল আছে”—সঙ্গে সঙ্গে ট্রোল, দেশদ্রোহের অপবাদ। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালিন সরকারর সমালোচনা করলেই তিনি ‘আওয়ামীলীগের দালাল’- ‘ভারতের এজেন্ট’।

এই প্রতিক্রিয়ার তীব্রতা আমাদের মনের খোলামেলা জানালা বন্ধ করে দিচ্ছে। মানুষ আর ‘মত’ শুনছে না, তারা শুধু ‘পক্ষ’ বা ‘বিপক্ষ’ দেখছে। বিতর্কের জায়গায় এসেছে নিষেধ, যুক্তির জায়গায় এসেছে ঘৃণা।

এই পরিস্থিতি দেখে বারবার মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের সেই কথা:

“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।”

আজকের চিন্তাশীল মানুষদের হয়তো আবার একলা চলার সাহস নিয়ে এগুতে হবে।

 

কৃষি, সংস্কৃতি ও মাটির ভাষা—নতুন সংবেদন

ত্রৈমাসিক কৃষানু যেহেতু মূলত গ্রামীণ সমাজ, কৃষি, সাহিত্যের মেলবন্ধন—তাই বর্তমান প্রসঙ্গেও কৃষকের সমাজ, মাটির সঙ্গে যুক্ত মানুষদের কথাও জরুরি হয়ে ওঠে।

মজার বিষয় হলো, গ্রামীণ মানুষ আজও তুলনামূলক বেশি সহনশীল, তাদের কথায় সংবেদনশীলতা আছে। একজন কৃষক জানেন, কোনো ফসল রাতারাতি হয় না—সময় লাগে। কিন্তু আমরা শহুরে মধ্যবিত্ত, নাগরিক মানুষ, যারা সোশ্যাল মিডিয়ার ঘূর্ণিতে থাকি, তারা আজ কিছু শুনেই প্রতিক্রিয়া দিই—পরিণতি না বুঝেই।

তাই সাহিত্যের কাজ শুধু শহরের রাজনীতি নয়, গ্রামীণ জীবনের মধ্যকার মানবিকতা, সহনশীলতা ও ঐতিহ্যকেও সামনে আনা।

 

সমাপ্তি : ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি কী?

আমরা যদি চাই—একটি গণতান্ত্রিক, ন্যায্য, মানবিক সমাজ গড়ে উঠুক, তবে আমাদের সহনশীলতার চর্চা করতে হবে—সর্বত্র।

  • স্কুলে, যেখানে ভিন্নমত শুনে শিক্ষক রাগ করবেন না;
  • বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে বিতর্ককে ভয় নয়, উৎসাহ দেয়া হবে;
  • পরিবারে, যেখানে সন্তানকে ‘চুপ করে থাকো’ না বলে, ‘শোনাও’ বলা হবে।

 

আর শিল্পী-সাহিত্যিকদের উচিত—কোনো ভয় ছাড়াই সত্য বলার চর্চা চালিয়ে যাওয়া। কারণ সাহিত্যের মূল শক্তি—তা সমাজকে চ্যালেঞ্জ জানাতে জানে। নইলে তা আর সাহিত্য থাকে না, হয়ে যায় “শিল্পসজ্জিত নীরবতা”।


Post a Comment

Previous Post Next Post