পুতিন-জিনপিংয়ের ফোনালাপ: ইসরায়েলের
হামলা আঞ্চলিক শান্তির জন্য হুমকি
ইরানে ইসরায়েলি হামলা নিয়ে পুতিন ও
জিনপিংয়ের কড়া নিন্দা। এই ফোনালাপ কী বার্তা দেয়? আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক
রাজনীতিতে এর প্রতিফলন নিয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা।
ভূমিকা
বর্তমান মধ্যপ্রাচ্য ও তার বাইরের
ভূ-রাজনৈতিক আবহে ইরানকে লক্ষ্য করে যেকোনো সামরিক আগ্রাসন এখন শুধু একটি
রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ইস্যু নয়, বরং তা গোটা অঞ্চলের তথা বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার ওপর
প্রভাব ফেলতে পারে। সম্প্রতি ইসরায়েলের ইরানবিরোধী হামলার প্রেক্ষিতে রাশিয়ার
প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যকার ফোনালাপে
এই উদ্বেগই প্রতিফলিত হয়েছে। উভয় নেতাই হামলার তীব্র নিন্দা জানান এবং এটি
"আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য সরাসরি হুমকি" হিসেবে অভিহিত করেন।
ঘটনার
প্রেক্ষাপট
ইসরায়েলের সামরিক ও গোয়েন্দা
সংস্থাগুলো সম্প্রতি সিরিয়া ও ইরাকের পর ইরানকেও লক্ষ্য করে যেসব হামলা চালিয়েছে,
তা আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে যখন এসব হামলা আন্তর্জাতিক
আইন কিংবা জাতিসংঘ অনুমোদন ছাড়াই পরিচালিত হয়। ইরান জানিয়েছে, তাদের পরমাণু
স্থাপনা ও সামরিক গবেষণা কেন্দ্রে হামলার চেষ্টা হয়েছে, যা শুধু আত্মরক্ষার অধিকার
লঙ্ঘন করে না, বরং পারমাণবিক যুদ্ধাবস্থার ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়।
পুতিন ও
জিনপিংয়ের অবস্থান
রাশিয়া ও চীন—দুটি শক্তিধর রাষ্ট্র
যারা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য, তাদের এই ফোনালাপ এই কারণে
গুরুত্বপূর্ণ যে, এটি স্পষ্টভাবে পশ্চিমা জোট বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার
মধ্যপ্রাচ্য মিত্র ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একটি কূটনৈতিক বার্তা বহন করে।
পুতিন বলেছেন, "একতরফা হামলা ও
যুদ্ধোন্মত্ত নীতির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে কোনো স্থায়ী শান্তি আসবে না।"
জিনপিং তার বক্তব্যে ইসরায়েলের এই আগ্রাসনকে “অবৈধ ও আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী”
বলে উল্লেখ করেন এবং বলেন, “এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার একমাত্র উপায় হলো রাজনৈতিক
সংলাপ ও আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা।”
কেন এই
বিবৃতি গুরুত্বপূর্ণ?
এই ধরনের যৌথ নিন্দা একাধিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ:
· মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা: রাশিয়া ও চীন উভয়ই মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে
চায়—তেল, অস্ত্র, কূটনৈতিক জোট ইত্যাদির মাধ্যমে। ইরানে হামলার বিরোধিতা করে তারা
নিজেদেরকে মুসলিম বিশ্ব ও নিরপেক্ষ দেশগুলোর কাছে ‘শান্তির পৃষ্ঠপোষক’ হিসেবে তুলে
ধরতে চায়।
· যুক্তরাষ্ট্রের হেজেমনির বিরুদ্ধে কৌশলগত বার্তা: ইসরায়েল যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র, তাই এই নিন্দা একভাবে পশ্চিমা হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধেও একধরনের প্রতিবাদ।
· ব্রিকস ও নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ার প্রেক্ষাপট: চীন ও রাশিয়া উভয়েই ব্রিকস জোটের মাধ্যমে একটি বিকল্প
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জোট তৈরি করতে চায়, যা পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার বাইরে।
ইরানকে এই জোটে অন্তর্ভুক্ত করাও এই বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ।
ভবিষ্যত
প্রতিক্রিয়া ও আশঙ্কা
যদি ইসরায়েল তার হামলা অব্যাহত রাখে,
তাহলে ইরান যে শুধু প্রতিরোধ গড়ে তুলবে তাই নয়, হিজবুল্লাহ বা হুথি বিদ্রোহীদের
মাধ্যমে বৈরী জবাব দিতেও পারে। ফলে লেবানন, ইয়েমেন, ইরাক এমনকি সিরিয়াও অস্থির হয়ে
উঠবে। এ অবস্থায় রাশিয়া ও চীন যেহেতু প্রকাশ্যে ইরানের পাশে অবস্থান নিয়েছে, তাই
এটি ন্যাটো বনাম রাশিয়া-চীন জোটের এক প্রকার পরোক্ষ সংঘাতে রূপ নিতে পারে।
এছাড়া চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড
ইনিশিয়েটিভ’-এর গুরুত্বপূর্ণ করিডোর ইরান হয়ে যায়, ফলে সেখানে যেকোনো যুদ্ধ এশিয়া
ও ইউরোপ উভয়ের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ।
উপসংহার
ইসরায়েলের ইরানবিরোধী আগ্রাসন শুধু
তেহরানের সমস্যা নয়; এটি আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং
বহুপাক্ষিক কূটনীতির জন্য হুমকি। পুতিন ও জিনপিংয়ের ফোনালাপ এক গভীর বার্তা দেয়
যে, বিশ্ব এখন আর একক কোনো পরাশক্তির একতরফা সিদ্ধান্ত মেনে নেবে না। বরং একটি
নতুন বহুপাক্ষিক বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে, যেখানে অঞ্চলভিত্তিক নিরাপত্তা সংলাপ ও
পারস্পরিক স্বার্থের ভারসাম্যই মূল পথনির্দেশক হতে যাচ্ছে।
إرسال تعليق