পাকিস্তান সেনাপ্রধানের উপহার দেওয়া ঘড়ির মাধ্যমে ইরানের সেনাপ্রধানকে মোসাদ হত্যা করেছে—এই দাবির সত্যতা যাচাই ও বিশ্লেষণ। আসল সত্য কি?
পাকিস্তান,
ইসরায়েল, মোসাদ এবং তথ্যযুদ্ধের এক আশ্চর্য গল্পের বিশ্লেষণ
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি
বিস্ময়কর দাবি ঘুরে বেড়াচ্ছে। বলা হচ্ছে, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম
মুনির ইরানের সেনাপ্রধান জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরিকে একটি ঘড়ি উপহার দিয়েছিলেন,
যাতে নাকি সংযুক্ত ছিল ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ট্র্যাকিং ডিভাইস। সেই
ডিভাইসের মাধ্যমে ইসরায়েল তাঁর অবস্থান শনাক্ত করে এবং বাঘেরিকে হত্যা করে।
প্রশ্ন হলো—এই গল্পের ভিত্তি কী? এ কি সত্যি, না কি এটি কেবল আরেকটি ষড়যন্ত্র
তত্ত্ব?
ঘটনার
প্রেক্ষাপট:
জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি, ইরানের
শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা, ১৩ জুন ২০২৫ তারিখে এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন বলে ইরানি
রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জানায়। সরকারি ভাষ্যে বলা হয়, এটি একটি প্রযুক্তিগত
ত্রুটির কারণে সৃষ্ট দুর্ঘটনা। তবে এই "দুর্ঘটনা"কে ঘিরে বিভিন্ন
অনানুষ্ঠানিক সূত্রে সন্দেহমূলক মন্তব্য ছড়িয়ে পড়ে।
তারপর থেকেই অনলাইন প্ল্যাটফর্মে
প্রচারিত হতে থাকে, ইরানি সেনাপ্রধানের মৃত্যু ছিল পূর্বপরিকল্পিত হত্যা—যার
সূত্রপাত একটি "ঘড়ির ফাঁদ" দিয়ে!
ঘড়ির
মাধ্যমে ট্র্যাকিং—মূল দাবি কী?
দাবি অনুযায়ী:
- মে ২০২৫–এ পাকিস্তান ও ইরানের সেনাপ্রধানদের মধ্যে একটি
আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ হয়।
- সেখানে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনির ইরানি
জেনারেলকে একটি দামি ঘড়ি উপহার দেন।
- সেই ঘড়িতে নাকি লুকানো ছিল একটি GPS বা এনক্রিপ্টেড
লোকেশন ট্র্যাকিং ডিভাইস।
- বাঘেরি সেনানিবাসের বাইরে পরিবারের সাথে ঘুরতে বের হলে,
এই ঘড়ির সিগন্যাল ধরেই ইসরায়েলি ড্রোন বা গোপন হামলায় তাঁকে হত্যা করে।
সত্যতা
যাচাই: গুজব না বাস্তবতা?
এই ধরনের গুরুতর অভিযোগ যাচাই করার
জন্য আমরা একাধিক উৎস ঘেঁটে দেখেছি:
১. কোনো
বিশ্বস্ত সংবাদমাধ্যম এই খবর প্রকাশ করেনি
Reuters, BBC, Al Jazeera, Associated
Press, কিংবা Washington Post—কোনো জায়গাতেই ঘড়ি বা মোসাদের ডিভাইসের প্রসঙ্গ
নেই। শুধু ইরানের সরকারি বক্তব্যে বলা হয়েছে, এটি একটি "দুর্ভাগ্যজনক বিমান
দুর্ঘটনা"।
২. উৎসহীন
সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে প্রচার
সর্বপ্রথম দাবি করা হয় Twitter
(বর্তমানে X) এবং YouTube–এর একাধিক সন্দেহজনক চ্যানেলে, যেখানে বলা হয়েছিল:
"MI6 সূত্রে খবর, ঘড়িটি আসলে
একটি এনক্রিপ্টেড ট্র্যাকিং ডিভাইস ছিল, যা মোসাদ অ্যাক্টিভ করে দেয়।"
কিন্তু এই ‘MI6 সূত্র’ আসলে কে বা কী,
তার ব্যাখ্যা বা প্রমাণ নেই। এমনকি এই খবর কোন মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়েছিল তাও
স্পষ্ট নয়।
৩.
পাকিস্তান, ইরান বা ইসরায়েলের কোনো বক্তব্য নেই
তিনটি দেশের পক্ষ থেকেই এই বিষয়ে কোনো
আনুষ্ঠানিক মন্তব্য আসেনি, যদিও এমন একটি গুরুতর অভিযোগে অন্তত এক পক্ষ প্রতিবাদ
করত—যদি এটি সত্য হতো।
৪. ঘড়ির
মাধ্যমে ট্র্যাকিং সম্ভব হলেও অস্বাভাবিক
হ্যাঁ, স্মার্টওয়াচ বা জিপিএস
ট্র্যাকিং ডিভাইস দিয়ে লোকেশন ট্র্যাক করা সম্ভব। তবে সামরিক-শ্রেণির সুরক্ষা
ব্যবস্থায় থাকা একজন শীর্ষ জেনারেল নিয়মিত স্ক্যান বা সেন্সর ব্যবহার করেন, ফলে
এমন ডিভাইস ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এরকম প্রকাশ্য উপহারের মাধ্যমে আক্রমণ
করা সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের ধরন নয়।
তাহলে এই
গল্প এল কোথা থেকে?
বিশ্লেষকদের মতে, এই ধরনের গুজব
ছড়ানোর পেছনে থাকতে পারে:
- তথ্যযুদ্ধ (Information Warfare):
ইরান–পাকিস্তান সম্পর্কের ওপর সন্দেহ সৃষ্টি করে পারস্পরিক অবিশ্বাস বাড়ানো। - সামাজিক উত্তেজনা বাড়ানো:
ইসরায়েল ও পাকিস্তানকে একই ষড়যন্ত্রে যুক্ত করে মুসলিম দুনিয়ায় ক্ষোভ উসকে দেওয়া। - ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি:
বাঘেরির মৃত্যুকে ‘শহীদ’ প্রমাণ করে জনগণের মনোভাব নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা।
উপসংহার:
বিশ্বাস, না বিভ্রান্তি?
এখন পর্যন্ত ঘড়ির মাধ্যমে ট্র্যাকিং
করে জেনারেল বাঘেরিকে হত্যার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এটি একটি ভিত্তিহীন, সোশ্যাল
মিডিয়ায় ছড়ানো গুজব।
এই দাবি তথ্য-উৎসহীন, অপ্রমাণিত এবং একটি দুর্বোধ্য ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মতোই আচরণ করছে। পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের দোষারোপ বা মোসাদের প্রযুক্তি ব্যবহারের কাহিনি যতটা না বিশ্বাসযোগ্য, তার চেয়ে অনেক বেশি নাটকীয়।
পাঠকের
জন্য পরামর্শ:
বিশ্ব রাজনীতির এমন সংবেদনশীল বিষয়ে
সোশ্যাল মিডিয়ার তথ্য প্রচারের আগে যাচাই করুন:
- খবরটি কোনো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে কি
না
- নির্ভরযোগ্য ও নিরপেক্ষ উৎস কি বলছে
- প্রচারকারীর উদ্দেশ্য কী হতে পারে
একটি ঘড়ি হয়তো সময় বলে দেয়। কিন্তু
কোনো গুজব—তা ছড়িয়ে দিলে সময় নয়, সমাজই নষ্ট হয়ে যায়।
Post a Comment