ইরান: হিজাবের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া মানবতা

 “মাহসা আমিনির হত্যাকে কেন্দ্র করে ইরানে নারীদের বিদ্রোহ, হিজাববিরোধী আন্দোলন এবং খোমেনির শাসনের বিরুদ্ধে গণজাগরণ। খোমেনি যুগের পতন কি আসন্ন?"



"ওরা যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে, তত কম মানে" — হীরক রাজার এই বাণী যেন নিখুঁতভাবে মিলে যায় আজকের ইরানের বাস্তবতায়। যেখানে শিক্ষার হার বেড়েছে, কিন্তু মানবতা কেবলই সংকুচিত হয়েছে। প্রযুক্তি ও জ্ঞানের অগ্রগতি যেন চাপা পড়ে গেছে মৌলবাদী শাসনের একনায়কত্বে।

 

মাহসা আমিনি: এক নাম, এক প্রতীক

২০২২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। ২২ বছরের কুর্দি তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যু যেন সেদিন পুরো দুনিয়াকে ঝাঁকিয়ে দিয়েছিল। তার একমাত্র অপরাধ ছিলো—হিজাব সঠিকভাবে না পরা। নৈতিকতা পুলিশের হেফাজতে মাহসার উপর চালানো নির্মম নির্যাতনের ফলে মৃত্যু হয় হাসপাতালে। ভাই আশকানকে সঙ্গে নিয়ে আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে বের হওয়া এই ভ্রমণটাই ছিল মাহসার জীবনের শেষ।

এই মৃত্যু শুধু একজন নারীর মৃত্যু ছিল না—এ ছিলো ইরানের লাখো নারীর দীর্ঘদিনের দুঃসহ অভিজ্ঞতার এক প্রতীকী বিস্ফোরণ। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া ছবি ও প্রতিবেদনগুলো আগুন ধরিয়ে দেয় বৈশ্বিক বিবেকে।

 

নারী বিদ্রোহ: হিজাব পুড়ছে, কণ্ঠ উঠছে

মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর গোটা ইরান যেন বিস্ফোরিত হয় প্রতিবাদের আগুনে। নারীরা স্কার্ফ খুলে, চুল কেটে, হিজাব পুড়িয়ে রাজপথে নামে। এই বিক্ষোভে কেবল নারীরাই নয়—তাদের পাশে ছিলেন পিতা, ভ্রাতা ও মা-ও। বহু শহরে শোনা যায় স্লোগান:

·       "খামেনি-রাইসি দূর হও, হিজাব আইন মানি না!"

 

নিপীড়নের পরিসংখ্যান: এক চোখ কাঁদে, এক চোখ জ্বলে ওঠে

হিউম্যান রাইটস রিপোর্ট অনুযায়ী, মাহসা আমিনির মৃত্যুর প্রতিবাদে সরকারি দমন-পীড়নে নিহত হন ৪৭৬ জন নিরীহ মানুষ। নারী, শিশু, ছাত্র—কেউই বাদ যায়নি। হাজার হাজার নারীকে কারাবন্দি করা হয়। যাদের অনেকেই হিজাববিরোধী মত প্রকাশ বা প্রতিবাদ করছিলেন মাত্র।

 

খোমেনির উত্তরাধিকার: হিজাব, বেত্রাঘাত ও মৃত্যুর আইন

১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের পর খোমেনির নেতৃত্বে ইরানে শুরু হয় এক নতুন মৌলবাদী শাসন। নারীদের জন্য হিজাব বাধ্যতামূলক করা হয় এবং হিজাব না পরলে ৭৪টি বেত্রাঘাতের শাস্তি নির্ধারিত হয়। ১৯৮৩ সালে চালু হয় বাল্যবিবাহের আইন, যেখানে মেয়েদের বিয়ের বয়স নেমে আসে ৯ বছরে। নারী স্বাধীনতার ছায়াও যেন মুছে ফেলা হয় এই সমাজব্যবস্থা থেকে।

 

প্রতিরোধ ও প্রতিশোধ: ইতিহাস কি পুনরাবৃত্তি ঘটাবে?

সাবা কোর আফসারি ও ইয়াসামান আরিয়ানির মতো সাহসী নারীদের দেওয়া হয় দীর্ঘ কারাদণ্ড। তবুও তারা থেমে যাননি। ইরানের প্রায় ৭২ শতাংশ নারী হিজাববিরোধী মনোভাব পোষণ করলেও, খোমেনির উত্তরসূরীরা জনগণের মতামতকে দমন করে, ভয়ভীতি ও নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে।

তবে ইতিহাস বলছে, দমন যত গভীর হয়, প্রতিবাদের বিস্ফোরণও তত জোরালো হয়। লাখো মানুষের চোখের জল, স্তব্ধ কণ্ঠ, ও মুখরিত চুল—সব মিলিয়ে ইরান ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। আজ না হোক, কাল—ইরানে গণজাগরণের ঢেউ তুঙ্গে উঠবে, এই বিশ্বাস ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।

 

শেষ কথা

ইরানের নারীদের এই সংগ্রাম কেবল একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়—এটি বৈশ্বিক মানবতার প্রশ্ন। ধর্মের নামে, নৈতিকতার নামে যে রাজনীতি নারীর স্বাধীনতাকে দমিয়ে রাখতে চায়, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এখন সময়ের দাবি। খোমেনির রাজত্ব একদিন ধসে পড়বেই—কারণ সত্য সবসময় সুন্দর, এবং শেষপর্যন্ত সত্যই জয়ী হয়।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post