শত্রুতার রূপান্তর: একসময় যারা ছিল বন্ধু, আজ তারা যুদ্ধের ময়দানে মুখোমুখি
ইসরায়েল-ইরান সংঘাত এবং ভূ-রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিত বিশ্লেষণ
✍️ Ataur Rahman Khan
![]() |
প্রতীকী ছবি |
ইরান-ইসরায়েল
যুদ্ধ: ধর্ম না রাষ্ট্রনীতি?
একসময়
মিত্র, আজ চরম শত্রু। কেন বদলে গেল ইরান ও ইসরায়েলের সম্পর্ক? কেমন ভূমিকা রাখছে
রাশিয়া, আমেরিকা ও পারমাণবিক রাজনীতি?
একসময় যারা একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু
ছিল, আজ তারা পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত বৈরী শক্তি। ইতিহাসে এমন বহু দ্বৈরথ রয়েছে
যেখানে বন্ধুত্ব রূপ নিয়েছে ভয়াবহ শত্রুতায়। রাশিয়া-আমেরিকা ও ইরান-ইসরায়েলের
দ্বন্দ্ব তেমনই দুটি ঐতিহাসিক উদাহরণ। আজ এই প্রবন্ধে ফিরে দেখা যাক, কীভাবে বদলে
গেছে বিশ্ব রাজনীতির দৃশ্যপট, আর কাদের ভুলে ও কাদের দূরদর্শিতায় আজকের এই
বাস্তবতা তৈরি হয়েছে।
রাশিয়া ও
আমেরিকা: আলাসকা বিক্রির বন্ধুত্ব থেকে পরমাণু প্রতিযোগিতার শত্রুতা
১৮৬৭ সালে মাত্র ৭.২ মিলিয়ন ডলারে
রাশিয়া আমেরিকার কাছে আলাসকা বিক্রি করে। আজ যার অর্থনৈতিক মূল্য প্রায় ১৫০ বিলিয়ন
ডলার। তখনো হয়তো কেউ কল্পনাও করেনি, এই দুই দেশ একদিন পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর
প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে একসাথে
লড়লেও, যুদ্ধশেষে বিশ্ব বিভক্ত হয়ে পড়ে পূর্বের সমাজতন্ত্র আর পশ্চিমের পুঁজিবাদে।
১৯৬২ সালের কিউবা মিসাইল সংকটে পৃথিবী
ছিল পরমাণু যুদ্ধের একেবারে কিনারায়। রাশিয়া কিউবায় মিসাইল বসাচ্ছিল, আর আমেরিকা
প্রতিশোধ হিসেবে তুরস্কে ক্ষেপণাস্ত্র বসায়। শেষ পর্যন্ত ১৩ দিনের সংকট শেষে
উভয়পক্ষ পিছু হটে। কিন্তু এর পর থেকেই প্রতিযোগিতা আর চাপিয়ে দেওয়ার রাজনীতিই
নির্ধারণ করেছে এই দুই দেশের সম্পর্ক।
১৯৭৯–৮৮ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত
যুদ্ধ রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে ভেঙে ফেলে। এক দশক না যেতেই, ১৯৯১ সালে সোভিয়েত
ইউনিয়নের পতন ঘটে, যার অন্যতম কারণ ছিল আমেরিকার কৌশলগত চাপ ও মস্তিষ্কনির্ভর
যুদ্ধনীতি। পারমাণবিক অস্ত্রের আধিক্য থাকলেও, রাশিয়া টিকতে পারেনি অর্থনীতি ও প্রযুক্তির
লড়াইয়ে।
ইরান ও
ইসরায়েল: বন্ধুত্ব থেকে শত্রুতায় রূপান্তরের এক নাটকীয় অধ্যায়
আজ যে ইরান ও ইসরায়েল পরস্পরের শত্রু,
একসময় তারা ছিল ঘনিষ্ঠ মিত্র। ১৯৪৯ সালে দ্বিতীয় মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে ইরান
ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৫৭ সালে ইরানের গোয়েন্দা সংস্থা সাভাক গঠিত হয় ইসরায়েলি
মোসাদের সহায়তায়। এমনকি ১৯৮০ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধে আমেরিকা যখন ইরাকের পক্ষে, তখন
ইসরায়েল ইরানের হয়ে ইরাকের ওসিরাক পারমাণবিক চুল্লিতে ‘অপারেশন অপেরা’
পরিচালনা করে।
সবকিছু বদলে যায় ১৯৭৯ সালে, যখন আয়াতুল্লাহ
খোমেনি ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন। ইরান তখন এক উগ্র ধর্মতান্ত্রিক
শাসনে চলে যায়, আর ইসরায়েল পরিণত হয় প্রধান শত্রুতে। খোমেনির নেতৃত্বে ইরান ধর্মীয়
মৌলবাদ, আঞ্চলিক আধিপত্য আর ইসরায়েল-বিরোধী ‘প্রক্সি’ গোষ্ঠীগুলোকে ব্যবহার করে এক
নতুন যুদ্ধ দর্শন কায়েম করে।
ইসরায়েল-ইরান
বর্তমান সংঘাত: ধর্ম নয়, কৌশলগত যুদ্ধ
সাম্প্রতিক যুদ্ধ ইসরায়েল ও ইরানের
মধ্যে ধর্ম নয়, বরং নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রনীতির দ্বন্দ্ব। ইসরায়েল চায় খোমেনির মৌলবাদী
শাসনের অবসান। এজন্য তারা লক্ষ্য করে শুধু খোমেনি ও তার বৃত্তকে—ইরানি জনগণ বা
বিরোধী দল নয়।
যুদ্ধের মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই
ইসরায়েল ধ্বংস করেছে ইরানের ডজনখানেক সামরিক কমান্ড স্ট্রাকচার, শীর্ষ বিজ্ঞানী,
গোয়েন্দা বাহিনীর নেতৃত্ব এবং বিমান শক্তি। ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম দশ বছরের
জন্য পিছিয়ে গেছে। অথচ ইসরায়েলের ক্ষয়ক্ষতি সামান্যই, কারণ তারা প্রথমেই জনগণের
নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
ইরান হিজবুল্লাহ–হুতি–হামাসের মতো
সংগঠন ব্যবহার করলেও সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়নি। একে বলা যায় ‘ছায়াযুদ্ধ’। কিন্তু আজ
যখন মুখোমুখি যুদ্ধের বাস্তবতা এসেছে, ইরান বোঝাতে চাচ্ছে তারা যুদ্ধ চায় না। ৭৫
গুণ বড় রাষ্ট্র হয়েও ইসরায়েলের কাছে আজ যুদ্ধবিরতির আবেদন জানাতে হচ্ছে তাদের।
পারমাণবিক
অস্ত্র কি আসলেই বিজয়ের গ্যারান্টি?
ইসরায়েলের হাতে ১০০–১৫০টি পারমাণবিক
বোমা থাকলেও তারা তা কখনো যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করেনি। পক্ষান্তরে ইরান একটিও
বোমা ছাড়াই পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি দিতে চায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো—আমেরিকা ও
ইসরায়েলের ঘিরে থাকা বিশ্বে এমন হুমকি অবাস্তব। স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ও এআই-নির্ভর
প্রতিরক্ষা কৌশল এখন মুহূর্তেই শত্রুর মাটিতে হামলা সম্ভব করে তোলে।
পাকিস্তানের উদাহরণই যথেষ্ট:
পারমাণবিক শক্তিধর হয়েও অর্থনীতিতে ভঙ্গুর, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রায়
অপ্রাসঙ্গিক।
বুদ্ধির
লড়াইয়ে কে এগিয়ে?
বর্তমান বিশ্বে আমেরিকা, ইসরায়েল, চীন
এমনকি ভারতও বুঝে গেছে—জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নই আধিপত্যের মূল
চাবিকাঠি। পারমাণবিক বোমা বা ‘মানব’ উৎপাদন ক্ষমতা নয়, যুদ্ধ জেতার জন্য দরকার
অর্থনৈতিক স্থিতি ও কৌশলগত দূরদর্শিতা।
চীন যেমন আমেরিকার বিরুদ্ধে সরাসরি
সংঘাতে না গিয়ে প্রযুক্তিগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিযোগিতায় নামছে। এটাই ভবিষ্যতের যুদ্ধ
কৌশল।
উপসংহার:
যুদ্ধ নয়, উন্নয়নই সত্যিকার বিজয়
আজ যারা ইসরায়েল ও ইরানের সংঘাতকে
ধর্মযুদ্ধ মনে করেন, তারা ইতিহাসের অজ্ঞান পাঠক। এটি একমাত্র নেতানিয়াহু বনাম
খোমেনির লড়াই। ধর্ম নয়, রাষ্ট্রনৈতিক দূরদর্শিতা ও প্রযুক্তির প্রয়োগে টিকে থাকার
যুদ্ধ। যেসব রাষ্ট্র এখনও মৌলবাদ আঁকড়ে ধরে জঙ্গিবাদে বিনিয়োগ করছে, তাদের পরিণতি
হতে বাধ্য সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তান কিংবা পাকিস্তানের মতো।
বিশ্বের যে রাষ্ট্র যত বেশি শিক্ষা,
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে আঁকড়ে ধরবে, তার ভবিষ্যৎ তত বেশি নিরাপদ ও সম্মানজনক হবে।
সারাংশে বলা যায়:
"শত্রুতা নয়, রাষ্ট্রনীতি ও নেতৃত্বই বদলে দেয় সম্পর্কের গতিপথ। আর পারমাণবিক
অস্ত্র নয়, ভবিষ্যতের যুদ্ধ জেতা যাবে মেধা, কৌশল আর অর্থনীতির শক্তিতে।"
Very good analysis
ردحذفThanks
حذفإرسال تعليق