ইসলামিক ডিপ স্টেট ও ইরানের সাম্রাজ্যবাদ: সৌদি যুবরাজের হুঁশিয়ারির প্রেক্ষিতে একটি সমসাময়িক বিশ্লেষণ

 

প্রতীকী ছবি

ইরান পাকিস্তানে ইসলামিক ডিপ স্টেট কিভাবে ধর্মকে হাতিয়ার করে সাম্রাজ্যবাদী শাসন কায়েম করেছে এবং সৌদি যুবরাজ কেন একে মানবতার জন্য হুমকি বলছেনএই নিবন্ধে রয়েছে গভীর বিশ্লেষণ।


ভূমিকা

আজকের বিশ্বে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ শব্দটি শুনলে অনেকের মনে শুধু পশ্চিমা দেশগুলোর আধিপত্যের ছবি ভেসে ওঠে। কিন্তু বাস্তবতা আরও জটিল। ইসলামি আদর্শের নামে যে গোপন রাজনৈতিক কাঠামো কাজ করে, তাকে আজ অনেকেই ‘ইসলামিক ডিপ স্টেট’ বলে চিহ্নিত করছেন। ইরান এবং পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্রগুলো এই ডিপ স্টেটের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে, যারা ধর্মকে শুধু ব্যক্তিগত বিশ্বাস নয় বরং শাসন ও সামরিক বাহিনীর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এই ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদ পশ্চিমাদের চেয়েও অনেকাংশে ভয়াবহ, কারণ একে পর্দার আড়াল থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো অধিকাংশ সময়ই আত্মঘাতী হয়ে পড়ে।

 

ইসলামিক ডিপ স্টেট: পরিভাষা ও বাস্তবতা

‘ডিপ স্টেট’ বলতে বোঝায় একটি রাষ্ট্রের সেই অদৃশ্য ক্ষমতাকাঠামো, যা সরকার পরিবর্তন হলেও তার অবস্থান অটুট থাকে। ইসলামিক ডিপ স্টেট হলো সেই বিশেষ রূপ, যেখানে ধর্মীয় নেতৃত্ব, মিলিশিয়া, গোয়েন্দা সংস্থা ও বিচার বিভাগ এক ছাতার নিচে সম্মিলিত হয়ে রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে।

ইরানে এই গোপন কাঠামোর নেতৃত্বে রয়েছে ‘সুপ্রিম লিডার’। নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ও সংসদ বাস্তবিকভাবে তার অধীন। এ এক অদ্ভুত শাসনব্যবস্থা—যেখানে ধর্মীয় ব্যাখ্যা ও ফতোয়ার ভিত্তিতে সংবিধান রদবদল হয়, রাষ্ট্র পরিচালিত হয় প্রি-স্টেট ঘোষণাপত্র বা ‘বিশ্ব ইসলামী বিপ্লব’-এর আখ্যানে।

 

ইরান: ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদের বর্তমান মুখ

ইরান আজ শুধু মধ্যপ্রাচ্যের একটি রাষ্ট্র নয়; এটি একটি ধর্মীয় সাম্রাজ্যের কেন্দ্র। একদিকে তারা হিজবুল্লাহ, হুথি বিদ্রোহী বা বিভিন্ন মিলিশিয়া গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা করে, অন্যদিকে নিজেদের "ইসলামী বিপ্লব" রপ্তানির নীতি গ্রহণ করে আশপাশের দেশগুলোতে অনুপ্রবেশ ঘটায়।

ইরান তাদের আধুনিক সংবিধান ছুঁড়ে ফেলে একটি ধর্মতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। সুপ্রিম লিডারের হাতে বিচার, নির্বাচন, সেনা, পুলিশ এমনকি সংবাদমাধ্যম পর্যন্ত জিম্মি। এই শাসনব্যবস্থা হিটলারের ফ্যাসিবাদী একনায়কত্বের আধুনিক ইসলামিক সংস্করণ। জনগণের ভোট, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, নারীর অধিকার—সবই ‘ধর্মের শত্রু’ হিসেবে দমন করা হয়।

 

পাকিস্তান: ১৯৭১ থেকে জাকার্তা মেথড

পাকিস্তানও ইসলামিক ডিপ স্টেটের আরেকটি ভয়ঙ্কর রূপ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগী ইসলামপন্থীদের হাতে ৩০ লক্ষ বাঙালির গণহত্যা ছিল ধর্মীয় জাতিগত শুদ্ধিকরণের চরম নিদর্শন। এ ঘটনার পরও তারা থেমে থাকেনি।

বর্তমানে আবারও এই চক্র সক্রিয়। ২০২৪ সালে বিভিন্ন অঞ্চলে রেজিম চেঞ্জের পেছনে এই ইসলামিক ডিপ স্টেটের মদদ রয়েছে বলেই ধারণা করছেন বিশ্লেষকেরা। আসন্ন জুলাই ঘোষণাপত্রও তার ইঙ্গিত বহন করে—যেখানে সংবিধানকে অকার্যকর করে, রাষ্ট্রের রক্ষাকবচ নষ্ট করে, জনগণের হাতে নয় বরং ধর্মীয় মিলিশিয়ার হাতে রাষ্ট্র তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এটাই জাকার্তা মেথড—যেখানে ধর্মীয় পরিচয়ের নামে একে একে ‘শত্রুদের’ হত্যা বৈধ হয়ে যায়।

 

সৌদি যুবরাজের সতর্ক বার্তা

এই পরিস্থিতিতে সৌদি আরব, বিশেষত ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান (MBS) এক নতুন বাস্তবতার কথা বলেছেন। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, ইরান বা পাকিস্তানের মতো দেশগুলো ধর্মকে ব্যবহার করে বর্বর রাষ্ট্র মডেল তৈরি করছে, যেটা শুধু মুসলিমদেরই নয় বরং মানবতার জন্য হুমকি। তার সংস্কারপন্থী নীতিতে ধর্মের ব্যবহার সীমিত করে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও আধুনিকতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা স্পষ্ট।

 

উপসংহার

ইরান এবং পাকিস্তানকে শুধুই ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে দেখা এক অর্ধসত্য। বাস্তবে তারা ধর্মের নামে গড়ে তুলেছে এক ভয়ঙ্কর সাম্রাজ্যবাদী ডিপ স্টেট, যেটা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পশ্চিমাদের জন্যও কার্যকর একটি হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। পশ্চিমারা যেমন তেল ও ভূরাজনীতির স্বার্থে ইসলামিস্টদের ব্যবহার করে, তেমনি এই ডিপ স্টেটও পশ্চিমাদের ট্যাকটিকসের সুবিধাভোগী হয়ে উঠে।

আমাদের সময় এসেছে এদের মুখোশ খুলে দেয়ার। ইসলাম মানে শান্তি, মানবতা, জবাবদিহিতা—কিন্তু ইসলামিক ডিপ স্টেট মানে মৃত্যু, মিলিশিয়া, মৌলবাদ। সুতরাং এসব রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অবসান না হলে, ধর্মের নামে গণহত্যা আর হিটলারের চেয়েও ভয়ঙ্কর স্বৈরতন্ত্র বারবার ফিরে আসবে।

Post a Comment

Previous Post Next Post