ড. ইউনূসের বিদেশ সফর ও মিথ্যাচারের ফুলঝুরি - সাব্বির খান

ইউনূসের বিদেশ সফর নিয়ে আলি শরিয়তির পর্যবেক্ষণ-

লন্ডন সফরে ডঃ ইউনূস 


বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত দশ মাসে ১১টি দেশ সফর করেছেন। এই মুহূর্তে যুক্তরাজ্যে ১১তম সফর চলছে। আমেরিকা, আজারবাইজান, মিশর, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন, থাইল্যান্ড, কাতার, ভ্যাটিকান সিটি, জাপান এবং বর্তমানে যুক্তরাজ্য; প্রধান উপদেষ্টার এই সফরের তালিকা বেশ দীর্ঘ। যুক্তরাজ্য বাদে বাকী দশটি সফরে প্রায় ২৬০ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে এবং ৭০ দিন সময় অতিবাহিত করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এইসব সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ কী অর্জন করেছে?


১১টি সফরের একটিও কোন দেশের আমন্ত্রণে সফর করেননি ইউনূস। সবগুলো সফরই মূলত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সম্মেলনে যোগদানের জন্য হয়েছে। সুযোগ মতো শুধু চীনের প্রেসিডেন্ট ও জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সাথে ছবি তুলেছেন। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই এইসব সফরে গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট কিছুই অর্জনের সুযোগ নেই।


এরপরেও এইসব সফরকে বাংলাদেশের মিডিয়া ও সরকারের তল্পিবাহকেরা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করেছে যে, বিরাট অর্জন করে ঘরে ফিরেছে ইউনূস। বাস্তবে যা থ্রি জিরো কিংবা শতাধিক জিরোর সমষ্টি বৈ কিছু নয়।  


২.

প্রকৃতপক্ষে এইসব সফরে স্বল্পমেয়াদি প্রচারণা ও ব্যক্তিগত ইমেজ নির্মাণ ছাড়া দেশের জন্য বাস্তবিক অর্জন প্রায় শূন্য। বরং ইউনূসের এইসব সফর অধিকাংশ ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্বকে খুশি করা, তাদের স্বার্থ রক্ষা করা, এবং নিজের ব্যক্তিগত প্রচারণা ও ব্র্যান্ডকে বৈশ্বিকভাবে আরও শক্তিশালী করার জন্য হয়েছে বলেই দৃশ্যমান হয়।


আমরা যদি অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখি, তাহলে বড় অর্জনের কথা বলতে গেলে হয়তো জাপানের ১.০৬ বিলিয়ন ডলারের অর্থায়নের কথা আসবে। তবে এটিও শেখ হাসিনা সরকারের আমলে গৃহীত বাংলাদেশের রেল প্রকল্প ও বাজেট সহায়তার ধারাবাহিকতা মাত্র। নতুন কোনো বড় বিনিয়োগ চুক্তি হয়নি। জাপানের এই অর্থায়নও মূলত পূর্বপরিকল্পিত এবং আওয়ামী লীগ সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রতিফলন মাত্র।


জাপানের আগে চীনের সঙ্গে ৯টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এরমধ্যে অধিকাংশই সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও সাংবাদিকতা সংশ্লিষ্ট। বড় কোনো শিল্প প্রকল্প বা বাজার সম্প্রসারণের বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। চীন সফরে এসব সমঝোতা স্মারক সই নিয়ে খোদ অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) বলেছিল, ‘প্রধান উপদেষ্টার মতো হাই-লেভেল ভিজিটে এসব ছোটখাট চুক্তি সমীচীন নয়’। চীন সফর ও সমঝোতা স্মারক সইয়ের মাধ্যমে বরং চীনের স্ট্র্যাটেজিক আগ্রহের দিকেই বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে নেওয়ার বার্তা দিয়েছে মুহাম্মদ ইউনূস।


মধ্যপ্রাচ্য সফরগুলোতেও (কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত) বড় বিনিয়োগ আসার আশ্বাস ছাড়া দৃশ্যমান কিছু আসেনি। সংযুক্ত আরব আমিরাতে শুধু একটি সম্ভাব্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। বাস্তবায়ন অনেক দূরের বিষয়।


কূটনৈতিকভাবে ইউনূসের সফরগুলো রাষ্ট্রের পয়সা খরচ করে তাঁর ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা ছাড়া ভিন্ন কিছু নয়।


৩.

যুক্তরাষ্ট্রে জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে দেখা করলেন, ছবি তুললেন। কিন্তু বাংলাদেশ কোনো বিনিয়োগ পেয়েছে, বা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে তেমনটা প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং একে একে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের নাগরিকদের যাতায়াত-ভ্রমণ ও অবস্থান আরও কঠিন হবার খবরই পাওয়া যাচ্ছে।


ভ্যাটিকানের সফরে ইউনুস তার “থ্রি জিরো” দর্শন তুলে ধরলেন। সেখানে তার ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ড প্রচার পেলেও বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কোনো লাভ হয়নি। অথচ সেখানে গিয়েছিলেন পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে। ব্যক্তিগত প্রচার চালানোর মাধ্যমে মূলত ‘রথ দেখা ও কলা বেচা’র মতো সফর করলেন।


সর্বশেষ চলমান যুক্তরাজ্য সফরে গিয়ে ‘কিংস চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড’ গ্রহণ করার কথা দেশীয় মিডিয়ার মাধ্যমে দেশবাসীকে জানানো হয়েছে। ২০২৪ সালে চালু হওয়া কিংস চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ডস মূলত বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিদের বিশেষ সম্মাননা স্বরূপ সম্মানিত করা হয়। ড. ইউনূস এই সম্মাননা পেতেই পারেন। কিন্তু কিংস ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে নমীনীদের তালিকায় ড. ইউনূসের নাম না থাকায় সন্দেহ ও সংশয় প্রকাশ পেয়েছে যে, তিনি এই অ্যাওয়ার্ডের জন‍্য মনোনীত হননি। দেশের মানুষকে বোকা বানানো হয়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টার্মার এর সাথে সাক্ষাতের কথাও জানানো হয়েছিল। কিন্তু পরে ইউনূসের তরফ থেকেই জানানো হয়েছে দেখা হবার সম্ভাবনা শূন্য। তাহলে কেন যুক্তরাজ্য সফরে গেছেন? 


ধারণা করা যায়, মূলত বিএনপি নেতা তারেক রহমানের সাথে বৈঠক করতেই এই সফর করছেন। একজন দণ্ডিত ও পলাতক ব্যক্তির সাথে সাক্ষাতে ইউনূসের দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ব্যক্তিগত লাভ থাকলেও দেশের কোন লাভ নেই। তাছাড়া তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে এনে ঢাকায় বসেই এই সাক্ষাৎ হতে পারতো। ইউনূস একদিকে তারেক রহমানকে দেশে ফিরতে দিচ্ছেন না, অপরদিকে ক্ষমতায় থাকার জন্য তারেক রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করতে লন্ডন সফরে চলে গেলেন রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় করে। একেই বলে কাণ্ডজ্ঞানহীন সরকার প্রধান!


৪.

এখন মূল প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের এই কঠিন সময়ে এই বিদেশ সফরগুলো আদৌ দেশের স্বার্থে হয়েছে কি না? যখন রেমিট্যান্সে ধীরগতি, বৈদেশিক ঋণ শোধের চাপ বাড়ছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটে রয়েছে- তখন ইউনূসের এই সফরগুলো দেশের অর্থনীতিতে কোনো তাৎপর্যপূর্ণ স্বস্তি আনতে পারেনি।


বরং সফরগুলো ব্যক্তিগত পুরস্কার গ্রহণ, পশ্চিমাদের প্রশংসা কুড়ানো এবং বাংলাদেশকে এক ধরনের ‘ওয়েস্টার্ন প্রক্সি স্টেট’-এ পরিণত করার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ড. ইউনূস যেভাবে পশ্চিমাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য নিজেকে ব্যবহার করছেন- তা বাংলাদেশকে আরও পরনির্ভরশীল করে তুলছে।


বিশ্বব্যাপী ওয়াশিংটন-লন্ডন-ব্রাসেলস জোটের স্বার্থের সঙ্গে বাংলাদেশকে মিলিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়ায় ড. ইউনূস এখন নিঃসন্দেহে একজন অন্যতম মুখ্য মাধ্যম। এই প্রক্রিয়ায় দেশের সার্বভৌম সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতা খর্ব হচ্ছে। তার সফরে কোথাও ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা, রোহিঙ্গা সংকট বা গঙ্গা-তিস্তা জলবণ্টন চুক্তির মতো জ্বলন্ত ইস্যুগুলো গুরুত্ব পায়নি এবং এসব সমস্যার কোনো অগ্রগতিও হয়নি।


৫ 

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিদেশ সফরের বিস্তারিত নিচে দেয়া হলো- 


১ম বিদেশ সফর

২৩–২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, নিউইয়র্ক। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে অংশগ্রহণ।


২য় বিদেশ সফর

১১–২২ নভেম্বর ২০২৪, বাকু, আজারবাইজান। ২০২৪ জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে অংশগ্রহণ।


৩য় বিদেশ সফর

১৮–২০ ডিসেম্বর ২০২৪, কায়রো, মিশর। ডি-৮ সম্মেলনে অংশগ্রহণ।


৪র্থ বিদেশ সফর

২১–২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ডাভোস, সুইজারল্যান্ড। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে অংশগ্রহণ।


৫ম বিদেশ সফর

১৩–১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত। ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্ট সামিটে অংশগ্রহণ।


৬ষ্ঠ বিদেশ সফর

২৬–৩০ মার্চ ২০২৫, হাইনান এবং বেইজিং, চীন। হাইনানে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ায় অংশগ্রহণ। এবং বেইজিংয়ে প্রথম দ্বিপাক্ষিক বৈঠক।


৭ম বিদেশ সফর

৩–৪ এপ্রিল ২০২৫, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড। বিম্‌সটেক সম্মেলনে অংশগ্রহণ।


৮ম বিদেশ সফর

২১–২৫ এপ্রিল ২০২৫, দোহা, কাতার। আর্থনা শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ।


৯ম বিদেশ সফর

২৬ এপ্রিল ২০২৫, ভ্যাটিকান সিটি। পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ।


১০ম বিদেশ সফর

২৮ মে-১ জুন ২০২৫, টোকিও, জাপান। ৩০তম নিক্কেই ফোরাম ফিউচার অফ এশিয়ায় অংশগ্রহণ। এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক।


১১তম বিদেশ সফর

১০-১৩ জুন ২০২৫, লন্ডন, যুক্তরাজ্য। কি উদ্দেশে এই সফর তা কেউ জানে না।


শেষকথাঃ


অনেকেই বলে থাকেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস বর্তমানে পশ্চিমা লবির একজন ‘সেল-আউট’। তার বিদেশ সফরের ফ্ল্যাশি ছবি দেখে বাংলাদেশের উগ্র ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক শিবিরের লোকেরা খুব আনন্দ পেতে পারেন; কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এগুলো বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় স্বার্থের পরিপন্থী।


বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারণ এখন যেন ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক এনজিও প্রজেক্টে রূপ নিচ্ছে- যেখানে প্রধান চরিত্র হলেন ড. ইউনূস। দেশীয় গণমাধ্যমে তিনি যেন এক বিশ্বনাগরিক, যার এক পায়ে হোয়াইট হাউজ, আর অন্য পায়ে ডাউনিং স্ট্রিট, কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশের মাটিতে তার শিকড় ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং ক্রমাগত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছেন আন্তর্জাতিক পরিসরেও।

এসব কি তিনি টের পাচ্ছেন নাকি তাঁর আমাত্যবর্গ অবহিত করছেন? সম্ভবত কোনোটাই হচ্ছে না।


#আলিশরিয়তি

Post a Comment

أحدث أقدم