দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক দাবাখেলা: ক্ষমতা, জলবায়ু ও গণতন্ত্রের সন্ধিক্ষণ

 
ছবিঃ প্রতীকী

উপক্রমণিকা

দক্ষিণ এশিয়া—প্রায় ১.৮ বিলিয়ন মানুষের আবাসস্থল, যেখানে অতীতের ইতিহাস, বর্তমানের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং ভবিষ্যতের জলবায়ু সংকট একসাথে মিলিত। ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বৈশ্বিক শক্তিগুলোর প্রভাব আর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দুর্বলতা এই অঞ্চলকে পরিণত করেছে এক জটিল দাবার বোর্ডে। এই লেখায় আমরা নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করব—দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান, আর্থ-সামাজিক চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার বাস্তবতা।

১. শক্তির ভারসাম্য: ভারতের উত্থান বনাম চীনের বিস্তার

  • ভারতের প্রসার: বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ এখন বিশ্বশক্তির সমীকরণে প্রভাব ফেলছে। কোয়াড, G20 ও প্রযুক্তি খাতে অগ্রগতি তাকে বৈশ্বিক খেলোয়াড় করে তুলেছে। তবু সীমান্ত বিরোধ, যেমন গালওয়ান উপত্যকায় সংঘর্ষ, এখনও অস্থিতিশীলতার উৎস।
  • চীনের কৌশল: CPEC ও হাম্বানটোটা বন্দরের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের বিনিয়োগ ও প্রভাব বাড়ছে। তবে ঋণের বোঝা এবং রাজনৈতিক প্রভাবের আশঙ্কা দেশগুলিকে দ্বিধায় ফেলছে।
  • যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাও ক্রমবর্ধমান: ভারতকে প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তিতে সহযোগিতা বাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র চীনের প্রতিপক্ষ হিসেবে তুলে ধরছে। এতে অঞ্চলটি জটিল কৌশলগত দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছে।

২. অর্থনৈতিক বাস্তবতা: উন্নয়ন বনাম বৈষম্য

  • অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য: ভারত উচ্চ প্রবৃদ্ধি দেখালেও শ্রীলঙ্কা ২০২২ সালে অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্বের মুখে পড়ে। পাকিস্তান এখনো IMF-এর ওপর নির্ভরশীল, মুদ্রাস্ফীতি আকাশছোঁয়া।
  • আয় বৈষম্য ও চাকরির অনিশ্চয়তা: ভারতের প্রবৃদ্ধির পেছনে ৬০%-এর বেশি শ্রমিক অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, যাদের সুরক্ষা নেই। এটাই অঞ্চলটির স্থায়ী দুর্বলতা।
  • জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি—বাংলাদেশ, মালদ্বীপের মতো দেশের অস্তিত্বই এখন ঝুঁকির মধ্যে। COP বৈঠকে দক্ষিণ এশিয়ার দাবি আরও জোরালো হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবায়ন দুর্বল।

৩. গণতন্ত্রের পথে বাধা: পরিচয় রাজনীতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতা

  • গণতান্ত্রিক চ্যালেঞ্জ: ভারতে সংখ্যাগুরুত্ববাদ নিয়ে উদ্বেগ, বাংলাদেশে বিরোধী কণ্ঠের পরিসর সংকুচিত, পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর ছায়া রাজনীতি এখনও বিদ্যমান।
  • পরিচয়ের রাজনীতি: ধর্ম, ভাষা ও জাতিসত্তা—এই উপাদানগুলো রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে। দক্ষিণ এশিয়ায় এসব ইস্যু প্রগতির চেয়ে বিভাজন সৃষ্টি করছে বেশি।
  • তরুণ প্রজন্মের মনোভাব: নেপাল ও ভুটানে উচ্চ শিক্ষিত তরুণেরা দেশত্যাগ করছে, কারণ দেশে সুযোগের ঘাটতি। এটি দীর্ঘমেয়াদে মানবসম্পদের অপচয় ডেকে আনছে।

৪. অঞ্চলগত উদ্যোগ ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা

  • আঞ্চলিক জোটের সীমাবদ্ধতা: SAARC কার্যত অচল, কারণ ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব। BIMSTEC তুলনামূলকভাবে সক্রিয়, তবে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা ইস্যুতে প্রয়োজন গভীরতর সহযোগিতা।
  • সমুদ্রপথে নিয়ন্ত্রণের লড়াই: ভারত মহাসাগরের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় চীন ও ভারতের মধ্যে নীরব প্রতিযোগিতা চলছে। এই পথ এখন শুধু বাণিজ্যের নয়, কৌশলগত নিরাপত্তার প্রধান ক্ষেত্র।

উপসংহার: ভবিষ্যতের দিকে নজর

দক্ষিণ এশিয়া এখন রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং জলবায়ু ঝুঁকির এক সন্ধিক্ষণে। এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা কেবল এখানকার মানুষের ভবিষ্যতের প্রশ্ন নয়—বরং বিশ্ব অর্থনীতি ও নিরাপত্তার জন্যও তা গুরুত্বপূর্ণ।

সচেতন হোন—তথ্যভিত্তিক আলোচনা ছড়িয়ে দিন।
আঞ্চলিক সংহতির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরুন।
জলবায়ু উদ্যোগ ও মানবাধিকারের পক্ষে সোচ্চার থাকুন।
তরুণদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যতের দাবিতে যুক্ত হোন।


তথ্যসূত্র

  • IMF, UNESCAP, World Bank
  • Brookings Institution, Carnegie India
  • The Diplomat, Al Jazeera, BBC

 

 


Post a Comment

أحدث أقدم