প্রবাসে ভালোবাসার ফাঁদ: রোমান্স স্ক্যাম এবং বিয়ের মাধ্যমে প্রতারণা

 
ছবিঃ দেশ রূপান্তর

উপক্রমণিকাঃ

স্বপ্ন আর উন্নত জীবনের আশায় যারা বিদেশে পাড়ি জমান, তাদের অনেকেই নতুন সংস্কৃতিতে নিজেদের মানিয়ে নিতে সংগ্রাম করেন। এই সময়, নিঃসঙ্গতা দূর করতে বা নতুন জীবনসঙ্গী খুঁজে নিতে গিয়ে তারা অনেক সময় প্রতারণার শিকার হন। বিশেষ করে, যখন এই প্রতারণা প্রেমের সম্পর্ক বা বিয়ের মতো আবেগঘন বিষয়কে কেন্দ্র করে হয়, তখন এর পরিণতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতে, যেখানে অভিবাসীরা প্রায়শই নতুন জীবন শুরু করতে যান, সেখানে এই ধরনের ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে।

রোমান্স স্ক্যাম: শুধু ডিজিটাল দুনিয়া নয়:

আগে 'রোমান্স স্ক্যাম' বলতে আমরা মূলত অনলাইন ডেটিং প্ল্যাটফর্ম বা সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচয় হওয়া ব্যক্তিদের দ্বারা প্রতারণাকে বুঝতাম। যেখানে প্রতারকরা মিথ্যা পরিচয় দিয়ে সম্পর্ক তৈরি করে টাকা হাতিয়ে নিত। কিন্তু এখন এই প্রবণতা আরও জটিল রূপ নিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে, বিদেশে ভাগ্য অন্বেষণে যাওয়া অথবা পড়াশোনার জন্য পাড়ি জমানো ব্যক্তিরাও সরাসরি প্রেমের সম্পর্কে জড়াচ্ছেন, যা পরে প্রতারণায় পর্যবসিত হচ্ছে।

বিয়ের আড়ালে প্রতারণা: নতুন আতঙ্ক

আমার জানা দুয়েকটি ঘটনা অনুযায়ী, এই ধরনের প্রতারণায় বিয়ে একটি বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেখানে প্রতারকরা একটি সম্পর্ককে বিয়ের দিকে নিয়ে গিয়ে ভুক্তভোগীকে আর্থিকভাবে নিঃস্ব করে দেয়। এই ধরনের ঘটনাগুলো বিশেষভাবে উদ্বেগজনক, কারণ এটি ভুক্তভোগীর আবেগ এবং বিশ্বাসের চরম অপব্যবহার করে।

আমার পরিচিতদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা দীর্ঘদিন যাবৎ যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় বসবাস করছেন। অনেকে তাদের সন্তান, নাতিপুতিকে স্থায়ী করে নিজে দেশে এসেছেন। তারা সবাই সচ্ছল জীবনযাপন করছেন। এরমধ্যেই আবার দুয়েকটি দুঃখজনক ঘটনাও জানি, যা নিম্নরূপঃ

ঘটনার বিবরণ:

·       একজন ব্যক্তি যিনি যুক্তরাষ্ট্রে ভাগ্য গড়তে গিয়েছিলেন। তিনি প্রেমের সম্পর্কে জড়ানোর পর প্রতারণার শিকার হন। লোকেরা যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশে থাকলে আর দেশে ফিরতে চান না। কিন্তু তিনি দীর্ঘদিন আমেরিকায় অবস্থান করেও প্রতারণার শিকার হয়ে সেখানে স্থায়ী হতে পারেননি। দেশে ফিরে আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে বিনা চিকিৎসায় মারা যায় লোকটি।

·       আরেকটি ঘটনা। একজন ব্যক্তি কানাডায় পড়শুনা করতে গিয়ে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়ান, যা পরবর্তীত বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়। বিয়েটি পাবারিকভাবেই হয়েছিলো, কিন্তু পরে জানতে পারেন যে মেয়েটি এবং তার পরিবার পরিকল্পিতভাবে তাকে প্রতারিত করার জন্য সম্পর্ক তৈরি করেছিলো। কানাডার আইনে স্ত্রীকে মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়ার বিধান থাকায়, তিনি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।

এই ঘটনাগুলো থেকে এটা স্পষ্ট যে, প্রতারকরা এখন শুধু অনলাইনেই সক্রিয় নয়, বরং তারা সরাসরি ভুক্তভোগীদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে এবং বিয়ের মতো সংবেদনশীল বিষয়কে ব্যবহার করে তাদের প্রতারণার জালে আবদ্ধ করছে।

প্রতারণার কৌশল:

প্রতারকরা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে থাকে, যার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হলো:

·        বিশ্বাস স্থাপন: প্রতারকরা ধীরে ধীরে ভুক্তভোগীর বিশ্বাস অর্জন করে এবং তাদের দুর্বলতার সুযোগ নেয়।

·        আর্থিক চাহিদা তৈরি: প্রতারকরা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ভুক্তভোগীর কাছ থেকে টাকা চায়, যেমন পারিবারিক সমস্যা, চিকিৎসার খরচ, বা আইনি জটিলতা।

·        আইনগত অজ্ঞতা: অনেক অভিবাসী তাদের নতুন দেশের আইন সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত না থাকায় প্রতারকদের কৌশল বুঝতে পারে না এবং সহজে তাদের শিকার হয়।

·        পরিবারকে জড়িত করা: কিছু ক্ষেত্রে, প্রতারকরা তাদের পরিবারকেও এই প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত করে, যা ভুক্তভোগীর জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে।

পরিস্থিতির ভয়াবহতা:

এই ধরনের প্রতারণার শিকার হলে একজন ব্যক্তির জীবনে দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এর কিছু উদাহরণ নিচে দেওয়া হলো:

·        আর্থিক ক্ষতি: ভুক্তভোগীরা তাদের সঞ্চিত অর্থ, সম্পত্তি এবং এমনকি ভবিষ্যৎ জীবনের অবলম্বনও হারাতে পারেন।

·        মানসিক আঘাত: প্রতারণার শিকার হলে ভুক্তভোগীরা গভীর মানসিক আঘাত পেতে পারেন, যা থেকে সেরে উঠতে অনেক সময় লাগে। এর ফলে বিষণ্ণতা, উদ্বেগ এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা দিতে পারে।

·        সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: প্রতারণার শিকার হওয়ার পর অনেকে পরিবার এবং বন্ধুদের কাছ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়, যা তাদের একাকীত্ব আরও বাড়িয়ে তোলে।

·        আইনগত জটিলতা: কিছু ক্ষেত্রে, ভুক্তভোগীরা প্রতারকের দেশে আইনি জটিলতায় পড়তে পারেন, যা তাদের পরিস্থিতি আরও কঠিন করে তোলে।

প্রতিরোধের উপায়:

এই ধরনের প্রতারণা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো মনে রাখা জরুরি:

·        সতর্ক থাকুন: বিদেশে নতুন সম্পর্কে জড়ালে তাড়াহুড়ো করবেন না। মানুষটিকে ভালোভাবে জানার জন্য সময় নিন। বিশেষকরে সে যদি ওই দেশের স্থায়ী বাসিন্দা না হয়ে অভিবাসী হয়, তাহলে এড়িয়ে চলুন অথবা অধিক সতর্কতা অবলম্বন করুন।

·        পরিচয় যাচাই করুন: আপনার সঙ্গীর পরিচয় এবং পটভূমি সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজখবর নিন। প্রয়োজনে তাদের পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে কথা বলুন।

·        আর্থিক লেনদেন এড়িয়ে চলুন: কোনো অবস্থাতেই আপনার সঙ্গীকে টাকা পাঠাবেন না, বিশেষ করে যদি আপনি তাদের ব্যক্তিগতভাবে ভালোভাবে না চেনেন।

·        আইনগত পরামর্শ নিন: বিয়ের আগে আপনার সঙ্গীর দেশের আইন সম্পর্কে একজন আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করুন। এটি আপনাকে কোনো আইনি জটিলতা থেকে রক্ষা করতে পারে।

·        নিজের অনুভূতি নিয়ে ভাবুন: যদি আপনার মনে কোনো সন্দেহ থাকে, তাহলে আপনার সঙ্গীর সাথে আপনার সম্পর্ক নিয়ে পুনরায় চিন্তা করুন। আপনার অন্তর্দৃষ্টি (intuition) প্রায়ই আপনাকে সঠিক পথ দেখাতে পারে।

·        সমর্থন খুঁজুন: পরিবার, বন্ধু এবং সহায়তা গোষ্ঠীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। তারা আপনাকে কঠিন সময়ে মানসিক এবং ব্যবহারিক সহায়তা দিতে পারে।

·        কর্তৃপক্ষকে জানান: আপনি যদি প্রতারণার শিকার হন, তাহলে অবিলম্বে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে জানান। আপনার পদক্ষেপ অন্যদের একই রকম অভিজ্ঞতা থেকে বাঁচাতে সাহায্য করতে পারে।

উপসংহার:

প্রবাসে প্রেমের নামে প্রতারণা একটি গুরুতর সমস্যা, যা অনেক মানুষের জীবন নষ্ট করে দিচ্ছে। এটা খুবই জরুরি যে যারা বিদেশে নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছেন, তারা যেন এই ব্যাপারে সচেতন থাকেন। এই ধরনের প্রতারণা শুধু আর্থিক ক্ষতি করে না, মানুষের মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে, যা সহজে পূরণ হয় না। এই বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করা এবং সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে নিজেদের শিক্ষিত করা দরকার। একই সাথে, যারা বিদেশে আছেন, তাদের উচিত একটি শক্তিশালী সামাজিক সমর্থন ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যাতে তারা কঠিন সময়ে একা না হয়ে যান।

 


Post a Comment

Previous Post Next Post