চট্টগ্রাম বন্দরের ভবিষ্যৎ: বিদেশি ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিতর্ক

 
প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবস্থাপনা বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক সিদ্ধান্তটি তীব্র রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে বিরোধী শিবির, এই পদক্ষেপের কড়া সমালোচনা করছে, যা জাতীয় স্বার্থ এবং সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে।

সিদ্ধান্তের নেপথ্যে কী?

প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকার চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, আধুনিকীকরণ এবং উন্নত পরিষেবা নিশ্চিত করার যুক্তি দিয়ে বিদেশি ব্যবস্থাপনার পক্ষে মত দিয়েছে। বলা হচ্ছে, বিদেশি অপারেটরদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, উন্নত প্রযুক্তি এবং বৈশ্বিক মানদণ্ড মেনে চলার সক্ষমতা বন্দরের কার্যকারিতা বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। বিশেষ করে, বন্দরের টার্নঅ্যারাউন্ড সময় কমানো, কন্টেইনার হ্যান্ডলিং দক্ষতা বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে বিদেশি অংশীদারিত্ব সহায়ক হতে পারে।

রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতা:

দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো, যার মধ্যে বিএনপি এবং অন্যান্য সমমনা দল উল্লেখযোগ্য, এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করছে। তাদের মূল আপত্তির জায়গাগুলো হলো:

  • জাতীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব: বিরোধীরা মনে করে, দেশের প্রধান বন্দরের ব্যবস্থাপনা বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী এবং এটি দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত। তাদের যুক্তি, কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি অবকাঠামুর নিয়ন্ত্রণ বিদেশি শক্তির হাতে ছেড়ে দেওয়া দীর্ঘমেয়াদে দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হতে পারে।
  • স্বচ্ছতার অভাব: এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় পর্যাপ্ত স্বচ্ছতা ছিল না বলে অভিযোগ উঠেছে। কোন প্রক্রিয়ায়, কোন বিদেশি সংস্থাকে এবং কী শর্তে এই দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, সে বিষয়ে স্পষ্ট তথ্যের অভাব রয়েছে।
  • দেশীয় সক্ষমতা অবমূল্যায়ন: বাংলাদেশের নিজস্ব পোর্ট ম্যানেজমেন্টের সক্ষমতাকে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিরোধীরা বলছে, সঠিক বিনিয়োগ, প্রশিক্ষণ এবং আধুনিকায়নের মাধ্যমে দেশীয় ব্যবস্থাপনায় বন্দরের দক্ষতা বৃদ্ধি করা সম্ভব।
  • আর্থিক প্রভাব: বিদেশি ব্যবস্থাপনার ফলে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে, এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করা হচ্ছে। বিদেশি অপারেটররা তাদের নিজস্ব মুনাফা সর্বোচ্চ করার চেষ্টা করবে, যা দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক নাও হতে পারে।
  • অস্থায়ী সরকারের এখতিয়ার: অন্তর্বর্তী সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের এমন বড় পরিবর্তন আনার এখতিয়ার নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যেহেতু এটি একটি নির্বাচিত সরকার নয়, তাই তাদের এমন মৌলিক নীতিগত পরিবর্তন আনার ক্ষমতা থাকা উচিত নয় বলে অনেকে মনে করেন।

পর্যালোচনা ও সম্ভাব্য প্রভাব:

চট্টগ্রাম বন্দরের বিদেশি ব্যবস্থাপনার সিদ্ধান্তটি বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলতে পারে:

  • অর্থনৈতিক প্রভাব: যদি বিদেশি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বন্দরের দক্ষতা সত্যিই বৃদ্ধি পায়, তাহলে তা দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যকে গতিশীল করতে পারে এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সহায়ক হতে পারে। তবে, এর ফলে দেশের রাজস্ব ক্ষতি এবং স্থানীয় কর্মসংস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
  • ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব: চট্টগ্রাম বন্দরের কৌশলগত অবস্থান এটিকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। বিদেশি ব্যবস্থাপনার ফলে বিভিন্ন পরাশক্তির মধ্যে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা আরও বাড়তে পারে।
  • জনগণের প্রতিক্রিয়া: এই ধরনের একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে জনগণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারে, যা সামাজিক অস্থিরতার কারণ হতে পারে।

ভবিষ্যৎ পথ কী?

চট্টগ্রাম বন্দরের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদের ব্যবস্থাপনার সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে নেওয়া উচিত। রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্বেগগুলো কেবল বিরোধিতার জন্য নয়, বরং জাতীয় স্বার্থের গভীর উপলব্ধি থেকে এসেছে। এই বিষয়ে একটি জাতীয় সংলাপের আয়োজন করা উচিত, যেখানে সরকার, রাজনৈতিক দলগুলো, বন্দর সংশ্লিষ্ট অংশীজন এবং বিশেষজ্ঞরা খোলাখুলি আলোচনা করতে পারে। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং দীর্ঘমেয়াদী জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া এই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে অপরিহার্য। শুধু অর্থনৈতিক লাভ বা আধুনিকায়নের যুক্তি নয়, বরং জাতীয় সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং দেশীয় সক্ষমতার বিকাশের দিকগুলোও সমান গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত। অথচ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জনাব শফিকুল আলম এক টিভি টকশোতে এ বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে বললেন, “We got mandate to do everything”-যা প্রকারান্তরে জনগনকে বৃদ্ধাংগুষ্টি দেখানোর শামিল এবং তাদের এখতিয়ার বহির্ভূত। তিনি কোথায় পেলেন এমন ম্যান্ডেট? এ ধরণের কথা জণগনকে আরো ভাবয়ে তোলে!

এই বিতর্কের অবসান ঘটাতে সরকার কি রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্বেগগুলোকে গুরুত্ব দেবে, নাকি নিজেদের সিদ্ধান্তেই অটল থাকবে?

 


Post a Comment

Previous Post Next Post