ছবিঃ নর্থইষ্ট নিউজ |
নিউইয়র্কে দীর্ঘদিন ‘রজার রহমান’ নামে পরিচিত ছিলেন বাংলাদেশের বর্তমান
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান। নর্থইস্ট নিউজের অনুসন্ধানে তার
যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘমেয়াদি অবস্থান ও একাধিক ঠিকানার সন্ধান মিলেছে, যা তাঁর
সরকারি পরিচয়ের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ এক ভিন্ন পরিচয়ের ইঙ্গিত দেয়।
গোপন নাম ‘রজার রহমান’ এবং ফেসবুক
প্রোফাইল
নর্থইস্ট নিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত—যা ছিল
বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টার উচ্চ প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত
হওয়ার পাঁচ মাস আগে এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার দশ
মাস আগে—খলিলুর রহমান ‘রজার রহমান’ নামে একটি ফেসবুক প্রোফাইল ব্যবহার করতেন।
ফেসবুক প্রোফাইলে ‘রজার রহমান’ পরিচয়ে তিনি ব্যক্তিগত জীবন, ভ্রমণ,
পারিবারিক ছবি ও তথ্য প্রকাশ করতেন। প্রোফাইলের মন্তব্য বিশ্লেষণে দেখা যায়,
আত্মীয়স্বজন ও ঘনিষ্ঠজনরা তাকে ‘খলিল ভাই’ বলেই সম্বোধন করতেন। তার স্ত্রীকেও
সেখানে ‘শাথি আপা’ বা ‘নুমান’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে।
এক মন্তব্যে ইয়াসমিন লস্কর খান লিখেছেন, “খলিল ভাই সুন্দর ঈদের চাদের পাশে
দাঁড়িয়ে খুশিতে উজ্জ্বল।” অন্য একটি মন্তব্যে দীনা রহমান লিখেছেন, “খুব সুন্দর
শাতি আপা এবং খলিল ভাই।” এসব মন্তব্য থেকে ধারণা করা যায় যে, ‘রজার রহমান’ ও
খলিলুর রহমান একই ব্যক্তি।
যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘমেয়াদি বসবাস ও
ঠিকানার ইতিহাস
খলিলুর রহমানের যুক্তরাষ্ট্রে সম্পর্কের শুরু অন্তত ১৯৯৮ সাল থেকে, তখনও
তিনি সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৯৮ সালের অক্টোবরে তিনি ওয়েস্টচেস্টার
কাউন্টির স্কারসডেল, নিউ ইয়র্কে ২৯, ব্রেটন রোড ঠিকানায় বসবাস করতেন।
নর্থইস্ট নিউজের অনুসন্ধানে আরও অন্তত ১০টি ঠিকানার সন্ধান মিলেছে, যেগুলি
নিউ ইয়র্ক ছাড়াও ম্যাসাচুসেটস ও কানেকটিকাট রাজ্যে অবস্থিত। উদাহরণস্বরূপ:
- ১, কোয়েকার
ল্যান্ড, গ্রিনউইচ, সিটি ০৬৮৩১, ফেয়ারফিল্ড কাউন্টি
- ১৮২, ওয়েভার
স্ট্রিট, গ্রিনউইচ, সিটি ০৬৮৩১
- ১৭, ক্লাইড রোড,
ওয়াটারটাউন, এমএ ০২৪৭২
- ১, লেইটন
স্ট্রিট, ইউনিট ১৩০৭, ক্যামব্রিজ, এমএ ০২১৪১
- ১১, সিনিক
ল্যান্ড, ইয়ঙ্কার্স, এনওয়াই ১০৭১০
যুক্তরাষ্ট্রে তার বসবাসের দীর্ঘ ইতিহাসকে ঘিরে খলিলুর রহমানের পরিবার এবং
আত্মীয়স্বজনদের অবস্থানের প্রমাণও পাওয়া গেছে। তার স্ত্রী নুরুন নাহার রহমান
ছাড়াও তার এক বোন সেলিন রহমান-ডিম্যাটিও নিউ ইয়র্কে একজন স্নায়ু বিশেষজ্ঞ
হিসেবে পরিচিত, যিনি একজন শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান নাগরিকের সঙ্গে বিবাহিত। তাদের বসবাস
ম্যানহাসেট, নিউ ইয়র্কে।
নর্থইস্ট নিউজের একটি ব্যাকগ্রাউন্ড রিপোর্ট অনুসারে, খলিলুর রহমান বর্তমানে
২৯, ব্রেটন রোড, স্কারসডেল, এনওয়াই ঠিকানায় বসবাস করছেন এবং সেখানে তিনি ১৯৯৮
সাল থেকে অবস্থান করছেন। তিনি পূর্বে গ্রিনউইচে চার বছর ও তার আগে ২০১৭ থেকে ২০২০
সাল পর্যন্ত মেরিল্যান্ডের অক্সন হিলে বসবাস করেছিলেন।
সামাজিক মাধ্যমে যুক্ত থাকার প্রমাণ
‘রজার রহমান’ নামের ফেসবুক প্রোফাইলে ভ্রমণ ও পারিবারিক মুহূর্তের বহু তথ্য
রয়েছে। যেমন, ২০১৮ সালে এক মন্তব্যে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি টরন্টোতে বেড়াতে
গেছেন। আবার ২০১০ সালের একটি পোস্টে তিনি লিখেছেন, “আগামীকাল জেনেভায় ফিরে
যাচ্ছি।” এসব পোস্ট এবং মন্তব্য থেকে পরিষ্কার, তিনি বিশ্বের বিভিন্ন শহরে নিয়মিত
যাতায়াত করতেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন স্থায়ীভাবে বসবাস করেছেন।
একটি উল্লেখযোগ্য পোস্টে তিনি লিখেছিলেন, “রজার তার জন্মদিনের সপ্তাহান্তে
প্যারিসে।” একই পোস্টে দেখা যায়, তিনি একটি ফাউন্টেন শোর পাশে তার পোষা কুকুরকে
বুকে নিয়ে ছবি তুলেছেন। এসব ব্যক্তিগত পোস্টে পরিচয় গোপনের কোনো চেষ্টা দেখা না
গেলেও, ‘রজার’ নামটি ব্যবহারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও বক্তব্য
১৭ মে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ দাবি করেছেন একজন বিদেশি নাগরিককে
নিরাপত্তা প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, যা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তিনি
প্রধান উপদেষ্টার কাছে তার পদত্যাগ দাবি করেছেন। সালাহউদ্দিন আহমেদের দাবির
প্রেক্ষিতে খলিলুর রহমান ১৮ মে বলেছেন, “আমি একজন বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে আমার
অধিকার পূর্ণ মাত্রায় প্রয়োগ করতে প্রস্তুত।” একই সঙ্গে তিনি বলেন, অভিযোগের
প্রমাণ আদালতের সামনে উপস্থাপন করতে হবে এবং এটি আহমেদ কর্তৃক প্রমাণিত হওয়া
দরকার।
উপসংহার
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে একজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তার ক্ষেত্রে এই
ধরনের পরিচয় গোপন এবং দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থান—বিশেষ করে ভিন্ন নামে সামাজিক
যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয়তা—নানান প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয়
নীতিমালার সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ এবং জাতীয় নিরাপত্তা পরিপ্রেক্ষিতে এর কী
প্রভাব পড়তে পারে—তা নিয়ে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক তদন্ত কিংবা বিবৃতি পাওয়া
যায়নি।
নর্থ ইষ্ট নিউজে প্রকাশিত তার ফেসবুক থেকে নেয়া আরো দুটি ছবিঃ
إرسال تعليق