হাদিস ছাড়া নামাজ পড়বেন কেমনে (পর্ব-৩)

 



আগের পর্বের আলোচনায় পরিষ্কার করেছি যে, রাসূল(সাঃ) এবং সাহাবীদের নামাজ ছিলো মূলত কুরআনের পাঠচক্র। সর্বস্তরের মানুষ কোরআনের পাঠচক্রে অংশ নিতে পারতো, এটাই ছিলো সেই সময়ের অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের সাথে কোরআনের অন্যতম প্রধান পার্থক্য। মধ্যযুগের ইউরোপে অর্থাৎ ৫ম খ্রিস্টাব্দ হতে পঞ্চদশ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সামাজিক মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বন্টন তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিল, যার প্রাধান স্তর ছিলো ধর্মযাজক শ্রেণী। এই ধর্মগুরুরা ছাড়া কেউ ধর্মগ্রন্থ পড়া তো দূরের কথা, সাধারণ মানুষ বাইবেল স্পর্শও করতে পারতো না। ধর্ম গুরুরা যা বলতো তাই ধর্ম মনে করা হতো!

 

অসংখ্য নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয় ধর্ম অবমাননার দায়ে। “উইচহান্ট”এর নামে হাজার হাজার নারীকে ডাইনি আখ্যা দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়। ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় ধর্মের নামে যাজক শ্রেণীর অত্যাচার নিপীড়নের অন্ধকার যুগের।

 

হিন্দু সমাজেও একসময় নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা ‘বেদ’ পড়তে বা শুনতে পারতো না। পূণ্যের নামে অগণিত বিধবা নারীকে স্বামীর চিতায় পুড়িয়েছে পূরোহিতরা। যখন মানুষ নিজের ভাষায় বেদ বাইবেল পড়তে শুরু করলো, ধর্মগুরুদের ধুতি খুলে গেলো।

 

ইসলামের নবী সারা জাহানের আলোকবর্তিকা হয়ে এসেছেন। অজ্ঞতা, অবিচার আর কুসংস্কারের অন্ধকার যুগে তিনি সাম্য, সৌহার্দ্য আর ন্যায় বিচারের আলো জ্বালিয়েছেন। জাত-পাত বৈষম্যের বিষাক্ত পৃথিবীতে তিনি আল্লাহর কিতাবের পাঠচক্রে আমীর-কামার সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করিয়েছেন। ধনী-ঋণী সবাইকে এক মজলিসে বসিয়েছেন। বেগম-দাসী সবাইকে তার মসজিদে প্রবেশাধিকার দিয়েছেন। এতীম, অভাবী মানুষকে তার জান্নাতের সিঁড়ি বানিয়েছেন।

 

ধর্মীয় অভিজাত শ্রেণীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কোরআন পড়তে সাধারণ মানুষকে ফরাসি বিপ্লব করতে হয়নি। ফরাসি বিপ্লবের হাজার বছর আগে নবী মোহাম্মদ আরবের ধুলা মলিন বেদুঈনদের কোরআনের আলোয় আলোকিত করে সারা জাহানের অধিপতি বানিয়েছেন। কিন্তু নবীর উত্তরাধিকারের নামে আমাদের ধর্ম গুরুরা মধ্যযুগের পোপ-পুরোহিত সেজে বসে আছে। এই কথিত আল্লামারা ‘সতীদাহ’ আর ‘উইচহান্ট’ যুগের অন্ধকার আমদানি করেছে ইসলাম ধর্মে।

 

কোরআন আর সাধারণ মানুষের মাঝে হাদিস তাফসীর ভাষা ব্যাকরণের এক অদৃশ্য দেয়াল তুলে কোরআনকে প্রস্তর যুগের দুর্বোধ্য শিলালিপি বানিয়েছে। মদিনা, আল-আজহার থেকে গুপ্ত জ্ঞান অর্জন না করলে কেউ কোরআন বুঝবে না! প্রতিটা মুসলমান মাতৃভাষায় বুঝে বঝে কুরআন পড়লে এসব আল্লামা আবু জেহেলরা মধ্যযুগের পোপ-পূরোহিতদের মতো মনের দুঃখে বনে চলে যাবে।

 

মসজিদে নববীর কোরআনের পাঠচক্র সমাজের সাম্য প্রতিষ্ঠা করেছে। সমাজের সকলে জানতো ধনীদের সম্পদে গরিবদের অংশ আছে। নারী-পুরুষ সবাই জানতো তাদের অধিকার ও কর্তব্য সম্বন্ধে। খলিফা জানতেন জনগণ তার ক্ষমতার সীমা জানে। স্বামী জানতো স্ত্রীর প্রতি তার দায় দায়িত্ব সম্পর্কে তার স্ত্রী ওয়াকিবাল। সুতরাং কেউ কাউকে হাইকোর্ট দেখাতে পারতো না।

 

সমাজের সবাই জানতো কারো নিন্দা করা, সম্মানহানি করা, অসুন্দর দেহসৌষ্ঠব বিশিষ্ট কাউকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, না জেনে কাউকে অপবাদ দেয়া ইত্যাদি- জিনাহ ব্যভিচারের চেয়েও গুরুতর পাপ। সুতরাং কারো সম্পর্কে কুৎসিত মন্তব্য করা- জনসম্মুখে ব্যভিচার করার চেয়েও নির্লজ্জ বেহায়াপনা বলে বিবেচিত হতো। কোন অপরাধের কি শাস্তি, তা সমাজের সকলে জানতো। সুতরাং অপরাধ করে কেউ পার পেতো না। কারণ, রাষ্ট্রের সকল নাগরিক ছিলো আইনজ্ঞ।

 

এখনো আরবরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে এবং কোরআন যেহেতু আরবদের মাতৃভাষায় সুতরাং তারা কোরআন পরিষ্কার বুঝতে পারে। তবুও তাদের দৈনন্দিন জীবনে কোরআন উপেক্ষিত। আমাদের আরবি জানা শায়খদের জীবনাচরণেও কুরআনের প্রাধান্য নাই। এর অন্যতম প্রধান কারণ আমরা যে আইন বা বিধানের চর্চা বা প্রয়োগ দেখি না, সে আইন আমরা মুখে বললেও বাস্তবে মেনে চলি না। (চলবে……)

(ইন্টারনেট অবলম্বনে)

Post a Comment

أحدث أقدم