![]() |
ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে |
শিরোনামটি কবি সুকুমার রায়ের বিখ্যাত চড়া “বিষম চিন্তা” থেকে নেয়া। শ্রদ্ধেয় কবির চিন্তা একটি শিশুর মস্তিস্কের কাল্পনিক ভাব। বর্তমানে শিশুরা কেমন চিন্তা করে জানিনা, তবে নিশচয়ই করে। এই যেমন আমার দশ মাস বয়সী নাতি নতুন যা দেখে তার প্রতিই উৎসাহ। নিয়ে নাড়াচাড়া করে বোঝার চেষ্টা করে, এই বস্তু দিয়ে কি করে? ওর বাবা-মা অফিস থেকে ভিডিও কল দিলে ফোন তার হাতে দিতে হবে। নিয়ে আগে মোবাইলে পেছন দিলে উল্টিয়ে দেখার চেষ্টা করবে, বাবা-মা কোথায়? আবার উলটা করে কানে ধরবে, যেভাবে তার বাবাকে দেখে কথা বলতে। চিন্তার রকম পাল্টেছে। তবে আমি আলোচনা করবো সমাজের ‘বড় শিশুদের’ নিয়ে। চলুন সমাজে বড় শিশুদের ভাবনায় একটু ডুব দেই।
নিয়মের নামে অন্যায়ের অনুশীলন: একটি সমাজ-চিত্র
আজকাল দেশে একটি অদ্ভুত ধারা ক্রমেই স্বাভাবিক হয়ে উঠছে—যা এক সময়
ব্যতিক্রম ছিল, আজ তা নিয়মে পরিণত হচ্ছে। শুধু নিয়মই নয়, এই নতুন তথাকথিত 'নিয়ম'কে
ঘিরে একধরনের সামাজিক অনুশীলন গড়ে উঠছে, যা আগামী দিনে আরও ব্যাপকতা পাবে বলেই
আশঙ্কা।
কোনো সরকারি কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলা এখন বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। অথচ
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের কাজই হলো জনসেবা নিশ্চিত করা—শাসন
নয়। আইন, সংবিধান ও নৈতিকতার মানদণ্ডে এদের কাজ বিশ্লেষণ করবেন সমাজচিন্তক,
সাংবাদিক, নাগরিক সমাজের সদস্যরা। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় সেই বিশ্লেষণের পরিসর
ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে।
আজ যদি কেউ বড় উদাহরণ দিয়ে কিছু বোঝাতে চায়, তাহলে তার বিপদ। সুতরাং
সবাই চুপ করে আছে, নিজ নিজ উপলব্ধি অনুযায়ী বিষয়গুলো বুঝে নিচ্ছে। আর এই চুপ করে
থাকা, এই মানিয়ে নেওয়াই আবার আরেক বিপদের ভিত্তি তৈরি করছে।
একটি ছোট উদাহরণ, যার তাৎপর্য বিশাল
ধরা যাক, আপনি রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছেন। আপনার সামনে একজন গাড়ি নিয়ে
চলছে নিয়ম মেনে, শৃঙ্খলায়। হঠাৎ পেছন থেকে একজন এসে হর্ন বাজিয়ে, জোর করে আপনার
গাড়ির গতিরোধ করে নিজে আগে চলে গেল। এটি হয়তো এক মিনিটের একটি দৃশ্য, কিন্তু এর
অর্থ অনেক গভীর।
এই কাজটা যিনি করলেন, তিনি হয়তো ভেবেই নিয়েছেন—"আমার আগে
যাওয়াটা স্বাভাবিক, এটা আমার অধিকারের মধ্যেই পড়ে।" আর আশ্চর্যের বিষয়,
সমাজের একটা বড় অংশ এটা মেনে নিচ্ছে। প্রতিবাদ নেই, প্রতিক্রিয়া নেই—শুধু মানিয়ে
নেওয়া।
এভাবেই একটি অন্যায় আচরণ দীর্ঘদিনে স্বাভাবিক নিয়মে রূপ নেয়। নতুন প্রজন্ম এই আচরণ দেখেই বড় হচ্ছে।
তারা ভাবছে, নিয়ম মানে হলো 'ক্ষমতা যার, নিয়ম তার'। আমাদের অজান্তেই একটা অনৈতিক
অনুশীলন নিয়মে পরিণত হয়ে যাচ্ছে।
কারা দায়ী?
এই উদাহরণটা যেমন ছোট, তেমনি তা প্রতীকি। আমরা নিজেরাই এই অনুশীলনের
জন্ম দিচ্ছি—হয় নিরব সম্মতিতে, নয়তো সক্রিয় অংশগ্রহণে। আমরা যখন নিজের স্বার্থে
চোখ বুঁজে থাকি, অন্যায়ের প্রতিবাদ করি না, তখনই আমরা সেই অন্যায়কে নিয়মে পরিণত
করতে সহায়তা করি।
যে সমাজে প্রশ্ন করা বিপজ্জনক, সেখানে অন্যায়ই
নিয়মে পরিণত হয়
প্রশ্ন করাই যদি অন্যায় হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে সত্যের চর্চা আর ন্যায়ের
প্রতিষ্ঠা কীভাবে হবে? চিন্তার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকার, রাষ্ট্রীয়
জবাবদিহিতা—এসব তখন শুধুই বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকে। বাস্তবে আমরা দেখি ‘নতুন
নিয়মে’ গড়ে ওঠা এক সমাজব্যবস্থা, যেখানে 'উন্নতি'র আড়ালে চলছে নৈতিক ও
ন্যায়বিচারের পরাজয়।
শেষ কথা
এই পরিবর্তন হঠাৎ করে আসেনি। আমরা সবাই, কোনো না কোনোভাবে এই
প্রক্রিয়ার অংশ। তাই চাইলে এখনও সময় আছে। ছোট ছোট উদাহরণ দিয়েই যেমন অন্যায়ের
অনুশীলন শুরু হয়, তেমনি ছোট ছোট প্রতিবাদ, সচেতনতা আর প্রশ্নের মাধ্যমেই তার
প্রতিকারে পথ তৈরি হতে পারে।
আমরা কি সেই পথ বেছে নেব?
إرسال تعليق