শুল্কচাপের মাঝেও মোদির চীন সফর: এসসিও সম্মেলনে উষ্ণতা ফেরাতে কূটনৈতিক তৎপরতা



যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের পরও চীন সফরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এসসিও সম্মেলনে তাঁর উপস্থিতি চীন–ভারত সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। ভূরাজনীতির উত্তাপে গুরুত্বপূর্ণ এই সফর নিয়ে বিশ্লেষণ।


যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্কনীতি নিয়ে টানাপোড়েনের মধ্যেই চীন সফরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আগামী ৩১ আগস্ট তিনি চীনের তিয়ানজিন শহরে শুরু হতে যাওয়া সাংহাই কো–অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবেন।


আজ বুধবার সরকারি সূত্রে মোদির এ সফরের তথ্য প্রকাশের পরপরই রাশিয়া থেকে তেল কেনার কারণে ভারতীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র, যার ফলে এসব পণ্যে মোট শুল্কহার দাঁড়ায় ৫০ শতাংশে।


যদিও এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সফরের ঘোষণা আসেনি, তবে একাধিক সূত্র জানিয়েছে, দুই দিনের এই সম্মেলনে যোগ দেওয়া নিশ্চিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। সফরের অংশ হিসেবে তিনি ৩০ আগস্ট এক দিনের জন্য জাপান সফরে যাবেন এবং সেখান থেকে সরাসরি তিয়ানজিনে পৌঁছাবেন।


উল্লেখযোগ্যভাবে, মোদি শেষবার চীন সফর করেছিলেন ২০১৯ সালে। পরবর্তীকালে ২০২০ সালের গালওয়ান উপত্যকায় ভারত–চীন সীমান্ত সংঘর্ষের ফলে দুই দেশের সম্পর্কের শীতলতা দেখা দেয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধীরে ধীরে সেই সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত মিলছে। ২০২৪ সালে রাশিয়ার কাজানে ব্রিকস সম্মেলনের ফাঁকে মোদির সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের এক বৈঠকও হয়েছিল। এসসিও সম্মেলনে মোদির অংশগ্রহণ সেই সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের আরেকটি পদক্ষেপ হিসেবে ধরা হচ্ছে।


সম্পর্কের বরফ গলার আরও কিছু ইঙ্গিত দেখা গেছে সাম্প্রতিক সময়ে। গত জুনে চীনে অনুষ্ঠিত এসসিও প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। জুলাই মাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে অংশ নেন এস. জয়শঙ্কর। এবার মোদি নিজেই শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে যাচ্ছেন।


এই সফর বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপিত শুল্কনীতির ফলে ভারত, চীন, রাশিয়া, ইইউ, জাপান, কানাডা, কোরিয়াসহ অনেক দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক জটিল হয়ে উঠেছে। এই অস্থির প্রেক্ষাপটে চীন সফর ভারতের জন্য এক নতুন কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।


সম্মেলনের ফাঁকে মোদির সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।


এসসিও সদস্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে—চীন, ভারত, রাশিয়া, ইরান, পাকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তান। রাশিয়া থেকে তেল কেনার জন্য ভারত যেমন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কচাপের মুখে পড়েছে, তেমনি চীনকেও এমন চাপের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। ইরানের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও খারাপের দিকে গেছে, যদিও ভারতের সঙ্গে ইরানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে ইতিবাচক।


৩১ আগস্ট ও ১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিতব্য দুই দিনের সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ উপস্থিত থাকবেন কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়। যদি থাকেন, তবে পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পর মোদি ও শরিফ প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হবেন। সীমান্তপারের সন্ত্রাসবাদ নিয়ে মোদি কী বার্তা দেন, তা নিয়েও কূটনৈতিক মহলে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে।


গত জুনে এসসিও প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের বৈঠকে সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতে পাকিস্তানের নাম না করে তীব্র সমালোচনা করেছিলেন রাজনাথ সিং। সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ।


সীমান্তবিরোধ সত্ত্বেও চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নতুনভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা স্পষ্ট। এই প্রয়াস মূলত বাণিজ্যিক স্বার্থ দ্বারা চালিত। ট্রাম্পের শুল্কনীতি সেই প্রয়াসকে ত্বরান্বিত করতে পারে। একইসঙ্গে রাশিয়া ও চীনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে, যেখানে ভারতও একটি ভারসাম্য রক্ষা করতে চায়।


এমন পটভূমিতে মোদির চীন সফর কেবল একটি কূটনৈতিক আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং ভূরাজনৈতিক সমীকরণে নতুন মাত্রা যোগ করার মতো এক তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ—যার ওপর নজর থাকবে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর।

সূত্র: প্রথম আলো অনলাইন


Post a Comment

أحدث أقدم