বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের রায় কি সত্যিই “বাজে”?—তত্ত্বাবধায়ক রায়, রাজনীতি ও বাস্তবতা


বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, সাবেক প্রধান বিচারপতি


২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগের ৭ বিচারপতির বেঞ্চ ৪–৩ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ত্রয়োদশ সংশোধনী (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। রায়টি “প্রস্পেক্টিভ” বা সম্ভাব্য; ফলে আগের তিনটি নির্বাচনের বৈধতা অক্ষুণ্ণ থাকে এবং ‘১০ম’ ও ‘১১তম’ সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় যাওয়ার অবকাশ রেখে দেয়—যদি সংসদ চায়। এই রায়কে “বাজে” বলার রাজনৈতিক বয়ান জোরাল হলেও, আইনি যুক্তিতে রায়টি মূলতঃ সংবিধানের মৌলিক কাঠামো—জনগণের সার্বভৌমত্ব, নির্বাহী জবাবদিহি ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা—রক্ষার ব্যাখ্যা। 

 

বিতর্কের জন্ম কেন

তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ১৯৯৬ সালে রাজনৈতিক অচলাবস্থা থেকে উঠে আসে; কিন্তু শুরু থেকেই এটি সাংবিধানিকভাবে “অস্বাভাবিক”—কারণ অনির্বাচিত ব্যক্তিদের হাতে স্বল্পমেয়াদে হলেও পুরো নির্বাহী ক্ষমতা যায়, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বেড়ে যায়, আর সংসদের জবাবদিহি স্থগিত থাকে। ১৯৯৯ সালের রিট (ডব্লিউপি ৪১১২/১৯৯৯) শেষ পর্যন্ত Abdul Mannan Khan v. Bangladesh নামে আপিলে গড়ায়। ২০০৪-এর হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল খারিজ করলেও আপিল বিভাগ ২০১১ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ মত দিয়ে উল্টো সিদ্ধান্ত দেয়। 

 

রায়ের মেরুদণ্ড: মৌলিক কাঠামো ও জবাবদিহি

প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের মূল পয়েন্টগুলো—

  • জনগণের সার্বভৌমত্ব কেবল অর্পণীয় নয় যে যখন খুশি “স্থগিত” রাখা যাবে।
  • নির্বাহী জবাবদিহি সংসদের কাছে—এটাই সংসদীয় গণতন্ত্রের হৃদয়; তত্ত্বাবধায়কে তা ভেঙে যায়।
  • রাষ্ট্রপতির অতিরিক্ত ক্ষমতা (অধ্যাদেশ/জরুরি অবস্থা/সেনা–বিষয়ক) আদি কাঠামোকে নতজানু করে।
  • তাই ১৩তম সংশোধনী মৌলিক কাঠামো–বিরোধী—অতএব বাতিল। একই সঙ্গে আদালত প্রস্পেক্টিভ ওভাররুলিং প্রয়োগ করে বলে: পূর্বের নির্বাচন বৈধ থাকবে, এবং ১০ম ও ১১তম সংসদ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় নির্বাচন হতে পারবে—“প্রয়োজন” প্রমাণিত হলে ও সংসদ চাইলে। 


অপারেটিভ অংশ (সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত অনুবাদ): “The Constitution (Thirteenth Amendment) Act, 1996 … is prospectively declared void … The election of the Tenth and the Eleventh Parliament may be held under the provisions of the above mentioned Thirteenth Amendment … on the age-old principles of necessity….” Supreme Court of Bangladesh

 

ভিন্নমত কেন ছিল

৩ বিচারপতি (নেতৃত্বে জে. এম. এ. ওয়াহাব মিয়া) যুক্তি দেন—বাংলাদেশের বাস্তবতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছে; ভোটকেন্দ্রের “লিটল ম্যান”—ভোটারের আস্থা—এখনই বাদ দেওয়া উচিত নয়। মূল বিতর্ক তাই: আদর্শ সংসদীয় কাঠামো বনাম আস্থাহীন রাজনৈতিক বাস্তবতা। (ভিন্নমত স্বাভাবিক—৪–৩ রায় নিজেই দেখায় ইস্যুটি “কনটেস্টেড”)। 

 

“মিথ” বনাম “তথ্য”

  • “এটা এক ব্যক্তির খেয়াল”—না; এটা এক ব্যক্তির খেয়াল নয়, ৭ জনের মধ্যে ৪–৩ সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়। 
  • “রায় সাথে সাথে কেয়ারটেকার উধাও”—না; আদালত ভবিষ্য থেকে অবৈধ বলেছে এবং দুটি নির্বাচন পর্যন্ত সুযোগ রেখেছে—রাজনৈতিক সমঝোতা হলে। 
  • “এমিকাসদের মত উপেক্ষা”—এমিকাস বাধ্যতামূলক নয়; বিভিন্ন মত আদালত বিবেচনায় নিলেও চূড়ান্ত মানদণ্ড ছিল মৌলিক কাঠামো। (রায়ের টেক্সটে বিস্তৃত আলোচনা আছে)। 

 

রায়ের পরের রাজনীতি: “খারাপ রায়” বয়ানের উৎপত্তি

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচন হয় তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। এই নির্বাচন স্বাধীনতার পর সবচেয়ে স্বচ্ছ নিরবাচন বলে ধরা হয়। নির্বাচনে আওয়ামীলীগ মিত্র দল বাদেই প্রায় ৪ পঞ্চমাংশ আসন পায়।

 

প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বের আপিল বিভাগের রায় ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ–নিয়ন্ত্রিত সংসদ ১৫তম সংশোধনী পাস করে কেয়ারটেকার ব্যবস্থাই তুলে দেয়। বিরোধী দলগুলো (বিশেষত বিএনপি) এটি “গণতন্ত্র খুন” হিসেবে প্রচার করে এবং রায়কে “আওয়ামীপন্থী” বলেন—এই রাজনৈতিক প্রচারই “বাজে রায়” তকমা জনমনে গেঁথে দেয়।

 

২০২৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্ট ১৫তম সংশোধনীর যে অংশ কেয়ারটেকার বাতিল করেছিল তা অবৈধ ঘোষণা করে। ২০২৫ সালের ৮ জুলাই সেই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পায়—যা রায়–পরবর্তী আখ্যানকে নতুন মোড় দিয়েছে। 

 

সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ: গ্রেফতার–বিতর্ক কেন বাড়ল

২৪ জুলাই ২০২৫ ঢাকায় ডিবি পুলিশ সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হককে গ্রেফতার করে; তাঁর বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলার কথা গণমাধ্যমে আসে—কোথাও রায়ের “পরিবর্তন/কারসাজি”–সংশ্লিষ্ট অভিযোগ, কোথাও খুনের অভিযোগ।

 

মামলাগুলো বিচারাধীন; আইনি সত্য নির্ধারণ আদালতের কাজ। তবে রায়–রাজনীতি–কে কেন্দ্র করে ব্যক্তিকে টার্গেট করার প্রবণতা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য উদ্বেগজনক বলেই বহু বিশ্লেষক মনে করছেন। 

নোট: বিচারাধীন বিষয়ে চূড়ান্ত মন্তব্য অনুচিত; এখানে যা বলা হলো—শুধু অভিযোগসংক্রান্ত সংবাদ–এর তথ্য।

 

তাহলে রায়টা “বাজে” ছিল, নাকি কঠিন–কিন্তু–যুক্তিসিদ্ধ?

আইনি মাপকাঠিতে রায়টি “বাজে” বলার ভিত্তি দুর্বল:

  • এটি সংখ্যাগরিষ্ঠ কনস্টিটিউশনাল অ্যাডজুডিকেশন
  • মৌলিক কাঠামো–তত্ত্ব অনুসরণে যুক্তি সাজানো।
  • রাজনৈতিক বাস্তবতার জন্য সফট–ল্যান্ডিং (দুটি নির্বাচন)–এর পথও খোলা রাখা।
    “বাজে” আখ্যা আসলে রাজনৈতিক ফ্রেমিং—যেখানে রায় নয়, রায়ের রাজনৈতিক ফলাফলের দায় বিচারকের ঘাড়ে চাপানো হয়েছে।

 

এক নজরে

১৯৯৬: ১৩তম সংশোধনী; কেয়ারটেকার চালু

  • ১৯৯৯: রিট চ্যালেঞ্জ; পরে Abdul Mannan Khan কেস নামে আপিলে যায়। 
  • ১০ মে/১২ মে ২০১১: আপিল বিভাগ ৪–৩ অসাংবিধানিক ঘোষণা; প্রস্পেক্টিভ; ১০ম–১১তম পর্যন্ত অবকাশ।
  • ৩০ জুন ২০১১: ১৫তম সংশোধনী পাস; কেয়ারটেকার বাতিল।
  • ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪: হাইকোর্ট ১৫তমের সংশ্লিষ্ট অংশ অবৈধ ঘোষণা; ৮ জুলাই ২০২৫: পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ।
  • ২৪ জুলাই ২০২৫: খায়রুল হক গ্রেফতার/আটক; পরবর্তীতে আদালতে পাঠানো/রিমান্ড–ইস্যু সংবাদ প্রকাশিত।

 

উপসংহার

রায় পছন্দ–অপছন্দের প্রশ্ন হতে পারে। কিন্তু “বাজে রায়”—এই রায়কে সেই সহজ বাক্সে ঢোকানো যায় না। এটি ছিল এক কঠিন সংবিধান–ব্যাখ্যা, যা জনগণের সার্বভৌমত্ব ও নির্বাহী জবাবদিহির পক্ষে দাঁড়ায়, আবার রাজনৈতিক বাস্তবতার জন্য সেতু–ব্যবস্থা রেখে যায়। পরবর্তী রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও প্রচারই রায়টিকে “বিতর্কিত” বানিয়েছে—রায়টি নিজে নয়। রায় খারাপ মনে হলে সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী আদালতের মাধ্যমেই প্রতিকার চাইতে পারেন।

 

দেশের সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানের রক্ষক। নিয়মতান্ত্রিকভাবে দেয়া রায়ের জন্য একজন সাবেক প্রধান বিচারপতিকে ‘কল্পনাপ্রসূত’ খুনের মামলায় হাতকড়া পড়িয়ে নিম্ন আদালতে হাজির করার নজির- যা ইতোপূর্বে কল্পনাও করা যায়নি। কোন অদৃশ্য আঙ্গুলি হেলনে এসব করা হচ্ছে- যা শুধু একজন ব্যক্তির প্রতি প্রতিশোধই নয়, দেশের ৩ টি মূল স্তম্ভের অন্যতম স্তম্ভ বিচার বিভাগকে পঙ্গু করা।


আরও পড়তে পারেনঃ  বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ২০২৫: রয়টার্সের প্রতিবেদনে যা উঠে এসেছে

 ------

মূলসূত্র (নির্বাচিত):


 

Post a Comment

أحدث أقدم