বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অন্তর্নিহিত সমীকরণ: রাজনৈতিক লড়াই ও কৌশলগত ভারসাম্য

 

প্রতীকী ছবি

১৯৮১ সালের অভ্যুত্থান পরবর্তীকালে সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক প্রভাব নতুন করে উন্মেষ লাভ করলেও, আধুনিক বাংলাদেশে সেই সংবেদনশীলতা অব্যাহত রয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও, সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে “গোষ্ঠী-পালটা-গোষ্ঠীর প্যাঁচপয়জার” এখন একটি বাস্তবতা। বর্তমানে চলছে এমন অবস্থার চরিত্রায়ন—যেমনটি আনন্দবাজার পত্রিকায় “উত্তাল মাঝ সমুদ্রে একটি জাহাজের” পরিস্থিতির সাদৃশ্য দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে।

 

১.  নিযুক্তির প্রেক্ষাপট ও রাজনৈতিক আনুগত্য

বিএনপি ও আওয়ামী লীগের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের মাঝে পার্থক্য স্পষ্ট। ২০০১–২০০৬ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা—বর্তমানে কর্নেল বা ব্রিগেডিয়ার—তাদের আনুগত্য স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি-র প্রতি। অপরদিকে ২০১০-এর পর নিয়োগপ্রাপ্ত মেজর বা লেফটেন্যান্ট কর্নেল পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্যের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এ ছাড়াও জামায়াতে ইসলামীর প্রভাবও সেনাবাহিনীতে বিদ্যমান বলে জানা যায়।

তবে সবাই একরকম হবে এমনটা মনে করা যুক্তিযুক্ত নয়। আমার মতে নিয়োগের সময়কাল মুখ্য নয়। যে সময়েই যিনি নিয়োগ পান, ব্যক্তিগত মানসিকতাই আসল।

 

২.  কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষার প্রয়াস: সেনাপ্রধানের ভূমিকা

আনন্দবাজারের মতে সেনা কর্মকর্তাদের বিষয়ে ৫৭ জনকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা আনে ইউনূস সরকার। তবে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান এটি আটকে দেন, যাতে “বড় গোলমাল” এড়ানো যায়। এই পদক্ষেপ মাঝখানের মধ্যস্থতা আর ভারসাম্য রক্ষার কৌশল প্রতিফলিত করে।

 

৩.  ভূ-রাজনীতি ও কৌশলগত সতর্কতা

সেনাবাহিনীর অন্দরের এসব সমীকরণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক কৌশলগত বিষয়ের দিকে তাদের নজর রয়েছে—যেমন রাখাইন-করিডোর কিংবা চীনের সাথে শিলিগুড়ি করিডোরের সংযোগ সংক্রান্ত প্রস্তাব। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে চলমান রাজনৈতিক ও গোষ্ঠীগত বিভাজনের প্রেক্ষাপটে এই কৌশলগত উদ্যোগগুলো সেনাপ্রধানের সতর্ক এবং অপেক্ষাকৃত ধারাবাহিক দৃষ্টি দাবী করে।

 

৪.  সামগ্রিক মূল্যায়ন এবং সংকট ব্যবস্থাপনা

বর্তমানে সেনাশাসনের ‘হারাম রেখা’ অতিক্রম না করলেও সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে রাজনৈতিক আনুগত্য ও গোষ্ঠীগত বিভাজনের কারণে একটি অবিচল ভারসাম্য রক্ষা প্রয়োজন। সেনাপ্রধান ওয়াকারের এই ভারসাম্যসাধনের ভূমিকাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

 

উপসংহার

এ ধরণের বিশৃংখলায় সেনাবাহিনীর চেইন-অব-কমান্ড ভেঙ্গে পড়ে যা সেনা আইনের ব্যত্যয়। নির্বাচিত সরকারের সময়ে এটা প্রকাশ্যে আসে না। পরবর্তী নির্বাচিত সরকার এলে শৃংখলা ভঙ্গকারী অবশ্যই আইনের আওতায় আসবে এবং উপরস্থের কমান্ড ভঙ্গকারী অবশ্যই সাজাপ্রাপ্ত হবেন। তাই সরকারি চাকরিতে, বিশেষ করে সেনাবাহিনীতে দলপ্রীতি নয়, দেশ প্রেম মুখ্য হওয়া কাম্য।

 

তবে আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে এখন যে “নানান সমীকরণ” চলছে বলে প্রচার হচ্ছে, এ প্রসঙ্গে বাইরে থেকে অস্থিতিশীল মনে হলেও, বাস্তবে এটি কৌশলগত ভঙ্গিমা ও রাজনৈতিক আচরণ নিয়ন্ত্রণের একটি চ্যালেঞ্জ। সেনাপ্রধানের মধ্যস্থতামূলক অবস্থান, অভ্যন্তরে বিভিন্ন পক্ষের উপস্থিতি এবং রাজনৈতিক মতাদর্শগত পৃষ্ঠপোশকতা—এই সব মিলিয়ে একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এতদ্বসত্বেও বাহিনী একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে।

 

তথ্যসূত্রঃ  Anandabazar পত্রিকা।


Post a Comment

أحدث أقدم