সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে বহুল আলোচিত
একটি রাজনৈতিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে—যেখানে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশি রাজনীতির দুই
বিতর্কিত ও দণ্ডপ্রাপ্ত চরিত্র, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান। যদিও এ বৈঠকের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ এখনও
জনসমক্ষে আসেনি, তবে বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশিত কিছু তথ্য ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
বিশ্লেষণ করে কিছু অনুমান করা সম্ভব।
১।
দণ্ডপ্রাপ্ত দুই চরিত্রের কৌশলী সমন্বয়
ড. ইউনূস ও তারেক রহমান—উভয়েই
বাংলাদেশে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি। একজন আদালতের রায়ে দণ্ডিত হয়ে বিদেশে অবস্থান
করছেন; অন্যজন ২০২৪ এর বিতর্কিত বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসে নিজস্ব দণ্ড বাতিলের
ব্যবস্থা করেছেন।
ড. ইউনূসের ক্ষেত্রে তাঁর সাজা ঘোষণার
পরপরই বিচারিক প্রক্রিয়ায় ও আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। অপরদিকে, তারেক
রহমানের দণ্ড মওকুফে একটি আইনি খুঁটি রাখা হয়েছে—সরকার চাইলে উচ্চ আদালতে রিট করে
তা পুনর্বহাল করতে পারে। ফলে এই বিষয়টিকে অনেকটা "লোডেড গান" হিসেবে
দেখা যায়—অর্থাৎ প্রয়োজনে চাপ সৃষ্টি বা প্রতিপক্ষকে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে
ব্যবহৃত হতে পারে।
এর অর্থ, যদি তারেক রহমান কোনো আশ্বাসে
আশ্বস্ত হয়ে দেশে ফিরে আসেন, তবে তাঁর জন্য পরিস্থিতি হঠাৎ বিপজ্জনক হয়ে উঠতে
পারে। অতীতের অভিজ্ঞতা বলছে, রাজনৈতিক আপসের প্রস্তাব যতটা মিষ্টি মনে হয়,
বাস্তবতা ততটাই কঠিন।
২।
নির্বাচন প্রশ্নে অস্পষ্টতা ও কৌশলী বিলম্ব
জানা গেছে, বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের কথা বলা হয়েছে। ড.
ইউনূসও নাকি এতে সম্মতি দিয়েছেন, তবে শর্তসাপেক্ষে—যদি প্রয়োজনীয় বিচার ও রাজনৈতিক
সংস্কার সম্পন্ন হয়।
কিন্তু এই কথাবার্তা থেকেই বোঝা যায়,
এটি কোনো স্থায়ী বা নির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি নয়। বরং এটি একটি সম্ভাব্য লক্ষ্য
মাত্র, যা বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় পাল্টাতে পারে। অনেক বিশ্লেষক মনে
করেন, ড. ইউনূস সময় ক্ষেপনের কৌশল অবলম্বন করছেন, যাতে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কাল
দীর্ঘায়িত করা যায় এবং সে সহ তার সমর্থিত বিভিন্ন পক্ষকে “সেফ এক্সিট” নেওয়ার
সুযোগ তৈরি হয়।
৩। আওয়ামী
লীগ ছাড়া নির্বাচন: ইতিহাস ও বাস্তবতা
নির্বাচন যতই নিরপেক্ষ বা
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হোক না কেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বিষয়
স্পষ্ট—আওয়ামী লীগকে উপেক্ষা করে বা নিষিদ্ধ করে কোনো টেকসই সরকার প্রতিষ্ঠা করা
সম্ভব নয়।
আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী
দল, দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি এবং নির্বাচনী রাজনীতিতে ধারাবাহিকভাবে সক্রিয়।
বাংলাদেশের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—যেসব নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করেনি (যেমন:
১৯৮৮, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, এবং ২০০৭-এর পূর্ব পরিকল্পিত নির্বাচন), সেগুলোর
ফলাফল ছিল অস্থিরতা, বৈধতা সংকট, এবং সরকারের পতন।
তথ্যসূত্র হিসেবে বলা যায়:
- ১৯৮৮ সালের পাতানো নির্বাচনের পর এরশাদের সরকারের পতন ঘটে
১৯৯০ সালে।
- ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন মাত্র এক মাসের মধ্যে
বাতিল হয় এবং পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
- ২০০৭ সালের প্রস্তাবিত নির্বাচন বাতিল হয়ে যায়
সেনা-সমর্থিত দীর্ঘ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কারণে।
৪।
নিষিদ্ধের ঝুঁকি ও আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির সম্ভাবনা
অনেক বিশ্লেষক আশঙ্কা করছেন, আওয়ামী
লীগকে নিষিদ্ধ করা হলে তারা ‘আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনৈতিক কৌশল’ গ্রহণ করতে পারে। যদিও
এই লেখকের মতে আওয়ামী লীগের বিপুল জনভিত্তি এবং সাংগঠনিক কাঠামো বিবেচনায় তারা
আইনের সীমার মধ্যেই রাজনীতিতে থাকতে চাইবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবভিত্তিক, কারণ
বৈধতা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ব্যতীত একটি বৃহৎ দলের জন্য দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকা
কঠিন।
৫। জাতীয়
ও আন্তর্জাতিক চাপ: একটি গুরুত্বপূর্ণ ভেক্টর (vector)
জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার
টুর্ক ইতোমধ্যেই রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের সম্ভাব্যতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারতসহ অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির
ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থও বিবেচনায় রাখতে হবে। ফলে, একটি একচেটিয়া নির্বাচন কিংবা
রাজনৈতিক দমন-পীড়নের মাধ্যমে সরকার গঠন করলে আন্তর্জাতিক বৈধতা পাওয়া কঠিন হয়ে
পড়বে।
উপসংহার:
নির্বাচন না সমঝোতা?
বর্তমান রাজনৈতিক চিত্র বলে দেয়, ড.
ইউনূস একটি সমঝোতার মাধ্যমে পরিস্থিতি ম্যানেজ করতে চাইছেন, যার মাধ্যমে তিনি
নিজেও একটি "সেফ এক্সিট" নিতে পারবেন এবং একটি দুর্বল, আপোসে তৈরি সরকার
প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। কিন্তু জনগণের বাস্তবতা আলাদা। সাধারণ মানুষ দীর্ঘদিনের
অভিজ্ঞতায় বুঝে গেছে—দেশ পরিচালনায় আওয়ামী লীগের মতো সংগঠিত ও বাস্তবমুখী দল আজও
কেউ দেখাতে পারেনি।
এই প্রেক্ষাপটে যে দলই হোক, জনগণের
প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়ে, বাংলাদেশের ইতিহাস ও জনমানসের অনুভূতি উপেক্ষা করে
ক্ষমতায় আসার চেষ্টার পরিণতি শুভ হবে না।
إرسال تعليق