রাজনৈতিক প্রতিশোধের ছায়ায় প্রশাসনিক গেজেট: ইতিহাসের আয়নায় ২০২৫-এর ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ

 



এই গেজেট কোনো সাধারণ প্রশাসনিক নির্দেশ নয়—এটি ইতিহাসে এক অশুভ মোড়। তাই প্রতিবাদ জরুরি, প্রশ্ন তোলা জরুরি। নইলে রাষ্ট্র, সংবিধান ও গণতন্ত্র—সবই হেরে যাবে।


প্রতীকী ছবি

২০২৫ সালের ১৭ জুন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার একটি গেজেট প্রকাশ করেছে যা দেশের প্রশাসনিক ও সাংবিধানিক ভারসাম্যে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এই গেজেট কতটা আইনত বৈধ—তা বিচার্য হলেও, তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হলো: এটি কতটা ন্যায়সঙ্গত? এর পেছনে কি কেবল প্রশাসনিক প্রয়োজন, নাকি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার গভীর উদ্দেশ্য? ইতিহাসের আয়নায় বিচার করলে দেখা যায়—এই গেজেটটি মূলত আওয়ামী লীগকে টার্গেট করেই তৈরি করা হয়েছে, যার আগে এরকম নির্দিষ্ট দলবিরোধী রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ বাংলাদেশে দেখা যায়নি।

 

স্বাধীনতার পর থেকে ধারাবাহিক পর্যালোচনা

১। ১৯৭২–১৯৭৫: মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব থেকে একদলীয় শাসন

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা তাকে একদলীয় শাসনের দিকে ঠেলে দেয়। ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতির নির্বাহী ক্ষমতা জোরদার করে একদলীয় 'বাকশাল' ব্যবস্থার সূচনা হয়। একটি বিশেষ গেজেটের মাধ্যমে সমস্ত সংবাদপত্র নিষিদ্ধ হয়, প্রশাসনে সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা পায়।

 

তুলনা: যদিও এই পদক্ষেপটি গণতান্ত্রিক বিচারে বিতর্কিত ছিল, কিন্তু সেটি ছিল সদ্য স্বাধীন দেশে দেশি-বিদেশি নানা চক্রান্তের কারণে রাজনৈতিক-নিরাপত্তাজনিত জরুরি প্রয়োজনে গৃহীত। কোনো নির্দিষ্ট বিরোধী দল তখনো সংগঠিত হয়ে উঠেনি যে তাকে টার্গেট করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিলো। তাছাড়া বাকশাল তৎকালিন প্রেক্ষাপটে একদলের মোড়কে বহুদল ও মতের সমন্বয়ে বহুদলীয় শাসন ব্যবস্থার উদ্যোগ বলেই অনেকে মনে করেন- যদিও সেটা বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ, বাকশাল ঘোষিত হয় ১৪ আগস্ট ১৯৭৫। ১৫ই আগষ্টেই তিনি নিহত হন এবং তাঁর সরকার উৎখাৎ হয়।

 

২। ১৯৭৫–১৯৯০: সামরিক শাসন ও গেজেটের মাধ্যমে ক্ষমতার বৈধতা

জিয়াউর রহমান এবং পরে এরশাদ সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তাঁরা একাধিক গেজেট ও সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতা বৈধ করেন। বিশেষ করে সংবিধানের পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় চরিত্র ও রাজনৈতিক ইতিহাসকে পাল্টে ফেলা হয়।

 

তুলনা: এখানে গেজেট ব্যবহৃত হয়েছিল ক্ষমতাকে প্রাতিষ্ঠানিক করার জন্য, কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো দলকে টার্গেট করে রাষ্ট্রীয় কাঠামো পুনর্বিন্যাস করা হয়নি। রাজনৈতিক দলসমূহের বিরুদ্ধে দমননীতি চললেও তা ছিল সামগ্রিক বিরোধিতার প্রতিক্রিয়া।

 

৩। ১৯৯১–২০০৬: পুনরায় গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরলেও বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পালাক্রমে শাসন করেছে। ২০০১-২০০৬ বিএনপির শাসনামলে হাওয়া ভবন নামক বিকল্প ক্ষমতা কেন্দ্র তৈরি হয়। রাজনৈতিক দমন, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ ওঠে। তবে এই সময়েও কোনো গেজেট দ্বারা আওয়ামী লীগকে সাংবিধানিকভাবে হটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়নি।

 

তুলনা: দমননীতি ছিল রাজনৈতিক, গোপন ও প্রাতিষ্ঠানিক। প্রশাসনিক গেজেট বা সংবিধানের কাঠামো ব্যবহার করে সরাসরি আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষ্ক্রিয় করা হয়নি।

 

৪। ২০০৯–২০২৩: আওয়ামী লীগ শাসনকাল

আওয়ামী লীগ দীর্ঘমেয়াদে শাসনকালে ডিজিটাল বাংলাদেশ, পদ্মা সেতু, বিদ্যুৎ খাত সংস্কার, ইউএন শান্তিরক্ষা মিশনসহ বহুবিধ সাফল্যের পাশাপাশি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন, বিরোধীদল দমন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ইত্যাদির মাধ্যমে সমালোচিত হয়। তবে প্রশাসনিক গেজেটের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিষ্ক্রিয় করার নজির নেই।

 

তুলনা: রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাদের সাংবিধানিক অবস্থানকে খর্ব করার লক্ষ্যে গেজেট বা সংবিধান ব্যাখ্যার একতরফা পরিবর্তন করা হয়নি।

 

২০২৫ সালের গেজেট: ব্যতিক্রমী ও দলনির্ভর পদক্ষেপ?

সাম্প্রতিক গেজেটে—

  • সংবিধান ব্যাখ্যার ক্ষমতা কার্যত নির্বাহী বিভাগের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে।
  • বিচার বিভাগের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে আনতে সুস্পষ্ট আইনগত শব্দচয়নের মাধ্যমে কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে।
  • সংবিধান ও প্রশাসনিক ব্যাখ্যার দায়িত্ব এমনভাবে সংজ্ঞায়িত হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধু পরিবারের আদর্শিক অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ করা সহজ হয়।
  • সময়কালটিও লক্ষণীয়—আওয়ামী লীগ দৃশ্যপটের বাইরে এবং একটি বিতর্কিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায়।

ফলে এটিকে শুধু প্রশাসনিক সংস্কার বলা যায় না। এটি রাজনৈতিক প্রতিশোধের রূপরেখা।

 

কেন বলা হচ্ছে "আওয়ামী লীগকে টার্গেট"?

১. গেজেট প্রকাশের সময় ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে যে এটি এমন একটি সময়ে এসেছে, যখন আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে কোণঠাসা। এই অবস্থায় তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রীয় ভূমিকাকে সীমিত করাই উদ্দেশ্য।

(ক)  সংবিধান ব্যাখ্যার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দখল ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে 'অসাংবিধানিক' ঘোষণা করার পথ খুলে দেয়।

(খ)  আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠান ও আইনগুলোর কার্যকারিতা অকার্যকর করার এবং আওয়ামীলীগের শাসনকালিন সময়ের সকল সিদ্ধান্ত অকার্যকর করার ভাষা গেজেটে স্পষ্টভাবে উপস্থিত।

 

উপসংহার: গেজেটের নামে প্রতিশোধ গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

রাষ্ট্রীয় গেজেট এমন একটি বিষয়, যা নিরপেক্ষ হওয়া উচিত। কিন্তু ২০২৫ সালের এই গেজেট রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে একটি নির্দিষ্ট দলকে সাংবিধানিকভাবে কোণঠাসা করার চেষ্টা করেছে—এমন অভিযোগ অমূলক নয়।

আজ যদি আওয়ামী লীগকে এইভাবে টার্গেট করা হয়, আগামীকাল অন্য কোনো রাজনৈতিক শক্তিও এর শিকার হবে।

এই গেজেট কোনো সাধারণ প্রশাসনিক নির্দেশ নয়—এটি ইতিহাসে এক অশুভ মোড়। তাই প্রতিবাদ জরুরি, প্রশ্ন তোলা জরুরি। নইলে রাষ্ট্র, সংবিধান ও গণতন্ত্র—সবই হেরে যাবে।


Post a Comment

أحدث أقدم