ছবিঃ গুগল থেকে |
মানবজাতি, ধর্ম এবং সঠিক পথ—এই তিনটি
বিষয়ে পবিত্র কোরআন অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে দিকনির্দেশনা দিয়েছে। সব মানুষই আল্লাহর
সৃষ্টি, এবং আল্লাহই ঠিক করেছেন কে হিদায়াত পাবে আর কে পথভ্রষ্ট হবে। আমরা অনেক
সময় নিজেদের মতবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ি, অথচ কোরআন আমাদের আহ্বান করে চিন্তা
করতে, বুঝতে এবং একে অপরের প্রতি সহনশীল থাকতে।
মানুষ ও
নবুয়তের সূচনা
আদম (আঃ)-এর ব্যাপারে কোরআনে
বিস্তারিত আলোচনা আছে, কিন্তু তাঁর সময়ে কোনো ধর্মগ্রন্থ অবতীর্ণ হয়নি। কোরআনে
প্রথম উল্লেখযোগ্য ধর্ম-চেতনার সূত্রপাত হয় ইব্রাহীম (আঃ)-এর সময় থেকে। তিনি ছিলেন
একেশ্বরবাদ এবং আনুগত্যের প্রতীক। কোরআনে বলা হয়েছে—
· "তোমাদের জন্য ইব্রাহীম ও তার সঙ্গীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম
আদর্শ।"
— সুরা মুমতাহীনা, আয়াত ৪
ইহুদি ও খ্রিষ্টানরাও তাঁকে নিজেদের
আদর্শ মানে। অতএব, কোরআন মানলে মুসলমানদেরও অবশ্যই ইব্রাহীম (আঃ)-এর আদর্শ অনুসরণ
করতে হবে।
ইসলামের
অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও বাস্তবতা
নবীজীর ইন্তেকালের পর থেকেই
মুসলমানদের মধ্যে প্রধান দুটি ধারা গড়ে ওঠে—শিয়া ও সুন্নি। শিয়ারাও
মুসলমান এবং তাদের মধ্যে রয়েছে ১২টি শাখা। তারা নামাজ পড়ে ৩ ওয়াক্ত, যেখানে
সুন্নিরা পড়ে ৫ ওয়াক্ত। আবার সুন্নিদের মধ্যেও রয়েছে চারটি মাযহাব—হানাফি, মালিকি,
শাফেয়ি ও হাম্বলি। এর বাইরে পীর, দল, মতবাদ, আবার ওয়াজিনদের মধ্যেও বিভক্তি রয়েছে।
এক ওয়াজী অন্য ওয়াজীর হাদিস মানে না। অনেকে পরস্পরকে কাফের পর্যন্ত বলে দেয়।
এই বিভ্রান্তির বাস্তবতা আল্লাহ নিজেই
বর্ণনা করেছেন—
· “আর যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন, তাহলে তিনি অবশ্যই তাদেরকে একই
জাতি করে দিতেন।”
— সুরা আশ-শুরা, আয়াত ৮
এটি প্রমাণ করে যে আল্লাহ নিজেই
বিভিন্ন জাতি ও ধর্ম সৃষ্টি করেছেন এবং এই বৈচিত্র্যই মানবজাতির পরীক্ষা।
সঠিক পথ ও
পথভ্রষ্টতা: আল্লাহর ইচ্ছা
আল্লাহ বলেছেন:
· “আর যদি আমি ইচ্ছা করতাম, তাহলে প্রত্যেক প্রাণীকে তার সঠিক পথ
প্রদর্শন করতে পারতাম, কিন্তু আমার পক্ষ থেকে এই বাক্য বাস্তবায়িত হবে যে, ‘আমি
অবশ্যই জিন এবং মানুষ সকল দিয়ে জাহান্নাম পূর্ণ করব।’”
— সুরা আস-সাজদা, আয়াত ১৩
এই আয়াত আমাদের বোঝায় যে, কেউ সঠিক
পথে থাকবে আর কেউ থাকবে না—এটাই আল্লাহর পরিকল্পনার অংশ। আমাদের কাজ হচ্ছে আল্লাহর
সন্তুষ্টি অর্জন, আর তা সম্ভব “আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, আখিরাত এবং সৎকাজ”-এর
ওপর বিশ্বাস স্থাপন ও আমলের মাধ্যমে।
কোরআন:
আঞ্চলিক না, সার্বজনীন?
অনেক সময় আমরা সুরা আশ-শুরা আয়াত ৭
পড়ে মনে করি, কোরান শুধু মক্কা ও আশেপাশের লোকদের জন্য—
· “এমনি ভাবে আমি আপনার প্রতি আরবী ভাষায় কোরআন নাযিল করেছি,
যাতে আপনি মক্কা ও তার আশ-পাশের লোকদের সতর্ক করেন এবং সতর্ক করেন সমাবেশের দিন
সম্পর্কে, যাতে কোন সন্দেহ নেই। একদল জান্নাতে এবং একদল জাহান্নামে প্রবেশ করবে।”
— সুরা আশ-শুরা, আয়াত ৭
কিন্তু অন্য আয়াতগুলো এই ব্যাখ্যাকে
পরিপূরণ করে:
· “আমি একে আরবী ভাষায় কোরআন রূপে অবতীর্ণ করেছি, যাতে তোমরা
বুঝতে পারো।”
— সুরা ইউসুফ, আয়াত ২
· “তার আরও একটি নিদর্শন হচ্ছে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃষ্টি এবং
তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্যে নিদর্শনাবলী
রয়েছে।”
— সুরা আর-রূম, আয়াত ২২
এখান থেকে স্পষ্ট হয়, কোরআন আরবি
ভাষায় নাজিল হলেও তা শুধুমাত্র আরবদের জন্য নয়; বরং সার্বজনীনভাবে মানবজাতির জন্য।
এই বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়—
· “আর এই কুরআন আমার নিকট অহীর মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে, যেন আমি
তোমাদেরকে এবং যাদের নিকট এটি পৌঁছবে তাদের সকলকে এর দ্বারা সতর্ক করি।”
— সুরা আনআম, আয়াত ১৯
সকল জাতির
জন্য সতর্ককারী
আল্লাহ আরও বলেছেন:
· “এমন কোন সম্প্রদায় নেই যার নিকট সতর্ককারী প্রেরিত হয়নি।”
— সুরা ফাতির, আয়াত ২৪
কোরানে ২৫ জন নবীর নাম আছে। তবে হাদিস
ও তাফসীর মতে নবী এসেছে প্রায় ১ লাখ থেকে ২ লাখ ২৪ হাজার পর্যন্ত। তারা পৃথিবীর
নানা অঞ্চলে, নানা ভাষায় এসেছেন।
আয়াতের
শ্রেণিবিন্যাস ও অপব্যবহার
কোরআনে দুই ধরণের আয়াত রয়েছে:
(১) কঠোর নির্দেশ ও শাস্তিসংক্রান্ত আয়াত
(২) সাধারণ উপদেশ বা প্রেক্ষাপটভিত্তিক নির্দেশনা
আমরা অনেক সময় কঠোর আয়াতগুলো উপেক্ষা
করি আবার অনেক সময় এমন আয়াত নিয়ে অতি-উত্তেজিত হই যা হয়তো নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে
নবীজী বা তাঁর পরিবারকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছিল। যেমন:
সুরা আল-আহযাব, আয়াত ২৮–৩৩ — যেগুলো নবীজীর স্ত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট।
ওহী ও
হাদিসের প্রসঙ্গ
অনেক হুজুর বলেন, ওহী দুই রকম—মাতলু
(প্রকাশ্য) ও গাইরে মাতলু (অপ্রকাশ্য)। কিন্তু কোরআন ব্যতীত অন্য কোনো
ওহী যদি থাকত, তবে নবীজীর পারিবারিক বিষয়গুলো কোরআনে আসতো না। নবীজীর ওহী
শুধুমাত্র তাঁর জন্য দিকনির্দেশনা হিসেবে আসতে পারে, উম্মতের জন্য ফরজ নয়। তাই
হাদিসকে বুঝতে হলে কোরানকে ভিত্তি করেই বুঝতে হবে।
পীর,
ফকির, সুপারিশ ও বিভ্রান্তি
কেউ মনে করেন, ‘পীর ধরলেই বেহেশত’।
কোরান এমন কোনো প্রতিশ্রুতি দেয় না। অনেকে বিশ্বাস করেন, নবীজী কাউকে রেখে বেহেশতে
যাবেন না। অথচ কোরআনে আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলেন:
· “বল, ‘আমি রাসূলদের মধ্যে নতুন নই। আর আমি জানি না আমার ও
তোমাদের ব্যাপারে কী করা হবে। আমার প্রতি যা ওহী করা হয়, আমি কেবল তারই অনুসরণ
করি। আর আমি একজন সুস্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র।”
— সুরা আল-আহকাফ, আয়াত ৯
বিতর্ক
নয়, আলোচনা হোক হিদায়াতের জন্য
আজকের পৃথিবীতে ৪১০০ এরও বেশি ধর্ম
রয়েছে। সবার সাথেই আমাদের সহানুভূতিশীল হতে হবে, কারণ—
· “আমি তোমার প্রতি যে কিতাব অবতীর্ণ করেছি তা সত্য। এটা
পূর্ববর্তী কিতাবের সমর্থক।”
— সুরা আল-ফাতির, আয়াত ৩১
· “এবং তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে ও তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ
হয়েছিল, যারা তদ্বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং আখিরাতের প্রতি যারা দৃঢ় বিশ্বাস
রাখে—এরাই পূর্ণ সফলকাম।”
— সুরা বাকারা, আয়াত ৪–৫
অতএব, বিতর্ক নয়—সত্য বোঝার জন্য
পরস্পর আলোচনার দরকার আছে। কারণ একমাত্র আল্লাহই জানেন, কে সঠিক পথে আছে।
উপসংহার:
আমরা যত মত, তত পথ—এই বাস্তবতা কোরআনেই
বলা আছে। তবে মুক্তি শুধুই সেইসব মানুষের জন্য, যারা আল্লাহর উপর ঈমান আনে, তাঁর
পাঠানো রাসূলদের মেনে চলে, আখিরাতে বিশ্বাস করে এবং সৎকাজ করে। মতবিরোধ থাকবেই,
কিন্তু সহনশীলতা ও আল্লাহর উপর আস্থা রেখেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আসুন, আল্লাহর দেয়া মূল নির্দেশনার
প্রতি মনোযোগ দেই, অহংকার নয়— বিনয়ের সাথে, বিতর্ক নয়— অনুসন্ধানের মানসিকতা নিয়ে।
মহান আল্লাহ আমাদের সঠিক পথ অনুসরণ করতে সাহায্য করুন।
আমীন-
إرسال تعليق