![]() |
মওদুদীপুত্র সৈয়দ হায়দার ফারুক |
ভূমিকা
দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ধর্ম একটি বড় মাত্রা
হিসেবে কাজ করেছে। বিশেষত পাকিস্তান ও বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর
উত্থান ও ভূমিকা নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর দৃষ্টিভঙ্গি উঠে
এসেছে এমন একজন ব্যক্তির কাছ থেকে, যিনি নিজেই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির জনক হিসেবে
পরিচিত মওলানা আবুল আলা মওদুদীর পুত্র — সৈয়দ হায়দার ফারুক মওদুদী।
২০১৩ সালের এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ নিতে ঢাকায় এসে দেয়া
এক সাক্ষাৎকারে তিনি প্রকাশ করেন কিছু বিস্ময়কর, কিন্তু ঐতিহাসিক সত্যসম্মত অভিমত।
এই নিবন্ধে আমরা তাঁর বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বাস্তবতা,
জামায়াতে ইসলামীর চরিত্র ও ইতিহাসের আলোকে কিছু বিশ্লেষণ তুলে ধরার চেষ্টা করব।
মওদুদী-পুত্রের
তির্যক মূল্যায়ন
সৈয়দ হায়দার ফারুক মওদুদী অকপটে স্বীকার করেন, জামায়াতে
ইসলামী মূলত ধর্মের নামে সুবিধাবাদের রাজনীতি করে। তার ভাষায়, “জন্ম-পরিচয়হীন
সন্তানের যেমন সম্পত্তিতে অধিকার থাকে না, জামাতেরও এ দেশে রাজনীতি করার কোনো
অধিকার নেই।” বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা এবং ১৯৭১ সালের গণহত্যায় অংশগ্রহণের
অভিযোগ এনে তিনি জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে মত দেন।
তিনি আরও জানান, তাঁর পিতা মওদুদী নিজেও তাঁর সন্তানদের
জামায়াত বা জমিয়তের রাজনীতি থেকে সরিয়ে রেখেছিলেন। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সঙ্গে
সন্তানদের কোনো সম্পৃক্ততা তিনি চাননি — এমনকি জামায়াতের সমাবেশ দেখাও নিষিদ্ধ ছিল
তাদের জন্য। এটি তুলনা করেছেন তিনি মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে, যে নিজের সন্তানকে কখনো
মাদক স্পর্শ করতে দেয় না।
জামায়াত: ইতিহাস ও
সুবিধাবাদী পুনরুৎ্থান
হায়দার ফারুক মওদুদীর ভাষ্য অনুযায়ী, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের
বিরোধিতা করলেও পরে মওদুদী বলেন, “আমি, জিন্নাহ আর ইকবাল মিলে পাকিস্তান বানালাম।”
এই দ্বিচারিতা পরবর্তীতে জামায়াতের রাজনীতিতেও প্রতিফলিত হয়েছে। ১৯৭১ সালে
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা, পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা ও গণহত্যায়
অংশগ্রহণ—এগুলো শুধুমাত্র রাজনীতির ব্যর্থতা নয়, মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল।
তিনি বলেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকার জামায়াতসহ পাঁচটি দলকে
নিষিদ্ধ করলেও, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমান আবারো তাদের রাজনীতিতে ফেরার
সুযোগ দেন। এই পুনরুৎ্থান ছিল মূলত সুবিধাবাদী রাজনৈতিক চাতুর্যের ফল, যা আজও
বহাল রয়েছে।
ধর্ম ও রাজনীতি:
সাংঘর্ষিক সমীকরণ
হায়দার ফারুক এক গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন, যা বর্তমান দক্ষিণ
এশিয়ার প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ — "ইসলাম রক্ষায় জামাত বা
হেফাজতের মতো কোনো দলের প্রয়োজন নেই।" তিনি বলেন, “ইসলাম হেফাজতের জন্য
আল্লাহই যথেষ্ট। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘এই কুরআনকে আমিই হেফাজত করব।’ সংগঠন করে
ইসলামকে রক্ষা করার দরকার নেই।”
এই বক্তব্যে তিনি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ধর্মকে
রাজনীতির হাতিয়ার বানানো শুধু ইসলামের বিকৃতি ঘটায় না, বরং ধর্মের পবিত্রতাকেই
প্রশ্নবিদ্ধ করে। তার মতে, জামায়াতের রাজনীতি ‘ফ্যাসিবাদী’ ধরনে পরিচালিত,
যেখানে আমিরকে চ্যালেঞ্জ করা যায় না — সেনাপ্রধানের মতো শাসকসুলভ আচরণে পার্টি
পরিচালিত হয়।
উপসংহার
সৈয়দ হায়দার ফারুক মওদুদীর বক্তব্য আমাদের সামনে একটি কঠিন
অথচ প্রয়োজনীয় প্রশ্ন তুলে ধরে — ধর্ম কি রাজনীতির হাতিয়ার হতে পারে? এবং
সেই হাতিয়ার যখন মানুষের জীবন, অধিকার, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়, তখন তা
কেবল ধর্মের অবমাননাই নয়, রাষ্ট্র ও মানবতার প্রতিও অপরাধ।
জামায়াত-ঘেঁষা রাজনীতির ইতিহাস ও বর্তমান আচরণ বিশ্লেষণ করলে
দেখা যায়, এদের চরিত্র ধর্মের অন্তরসার নয়, বরং ধর্মকে ছদ্মবেশ হিসেবে ব্যবহার
করে রাজনৈতিক ও আর্থিক ফায়দা লুটে নেওয়ার কৌশল। এই প্রেক্ষাপটে হায়দার ফারুকের
বক্তব্য শুধু একজন সন্তানের পিতার উত্তরাধিকার সম্পর্কে মত নয়, বরং সময়ের দাবি এবং
সত্যের স্পষ্ট উচ্চারণ।
إرسال تعليق